Sunday, April 18, 2021

এ ভাবে হাঁটতে হাঁটতে একদিন...

                    


আজ আঠরই এপ্রিল, রোজ রবিবার।
ইউরোপ জুড়ে বন্ধের দিন, সপ্তাহিক ছুটির দিন,
দোকানপাট সব বন্ধ, প্রায় নিঃষ্প্রাণ নিরব নিস্তব্দ-
 চারিদিকে পশু পক্ষি  জনমানব হীন।
ঘরে বসে বসে ভোর হচ্ছি,একটু বাহিরে 
হেঁটে আসলাম।বেশ কিছুক্ষন হাঁটতে হাঁটতে নীল 
আকাশের গায়ে একপাশে দেখলাম দুরন্ত মেঘ বালিকারা 
খেলা করছে।আরেক পাশে দেখলাম অবোধ শিশুর মত সাদা মেঘেরা 
ঘুমাচ্ছে। মাঠে মাঠে সবুজ ঘাঁসেরা সতেজ হয়ে উঠছে।
গাছে গাছে নতুন কুঁড়ি, বুঝি বসন্তের আগমনি গানের সাজানো মঞ্চ,
 গ্যালারি খালি দর্ষক হীন। 
এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এলাম ঘরে।
সময় কাটছে তুমিবিনা বিমূর্ত্যু এক পরিবেশে।
বিশাল এক এপার্টমেন্ট, চারদেয়ালের বন্দিখানা,
বড় বড় সাতটি কাঁচের জানালা, একটি কাচের  
বাঁকি সাতটি কাঠের দর্জা, ভিতরে বসে মূর্তমান 
আমি একা,দোলনা  কেদারায় বসে গ্লাসের ভিতর দিয়ে 
দেখছি প্রাণোবন্ত দুরের দিগন্তকে।
এভাবেই দেখতে দেখতে--
হয়তো বা কোন একদিন নিভে যাবে দু নদীর আলো।
হয়তো বা বিবর্ণ হবে লাবণ্য অবয়বের জ্যোতি,
হয় তো বা বন্ধ হয়ে যাবে অনবদ্য জীবনের জলপ্রপাত।
সেদিন কেউ আর আমাকে দুঃখ কষ্ট যন্ত্রনা দিতে আসবেনা,
দুহাতে ঝড়ায়ে ধরে তুমি ও আর ভালোবাসবেনা।
ভূলে যাব অকারণে গত জীবনের যত মান অভিমান,
ভুলে যাব যাপিত জীবনের সকল গিতী কবিতা।
ভুলে যাব চেনা জানা শুনা সকল মুকগুলো। 
ভুলে যাব নৈঃসর্গের সকল সোন্দর্যকে।
এ ভাবে হাঁটতে হাঁটতে একদিন হঠাৎ করে চলে যাব
অচেনা অজানা কোন পৃথিবীতে।
বিশ্বাস করো, কছম খেয়ে বলছি,
একদিকে আমার তাড়া করছে করোনা,
আরেক দিকে তাড়া করছে দুষ্ট সমাজের যত যন্ত্রনা,
বোধ হয় এবার মরে গেলেই বাঁচি।
না না বাবা না-
একদল নাস্তিক আছে- তারা বলবে মৃর্ত্যু কামনা,
কবিরা গুনাহ।হায় হায় কবি-রা কি বুঝে,
কি জিনিস কবিরা গুনাহ?
                    ১৮,০৪.২১, জার্মানী,

কুলাঙ্গারদেরকে বলছি...

                                                              






আমরা সব কিছু দেখছি এবং শুনছি।
হ্যেই স্বদেশের যতসব কুলাঙ্গার গভেটের দল,
হ্যাঁ তোদেরকেই বলছি।শোন মিরজাফরের বংশধর,
গাদ্দার রাজাকারের আন্ডা বাচ্চারা শুন তোদেরকে বলছি।
শহীদের রক্তে ভেজা স্বদেশের প্রবিত্র মাটি নিয়ে তোরা যারা ষড়যন্ত্র 
করছিস,  তোদের একটিকেও আমরা ছাড়বোনা।
আমরা জানি এবং বুঝি  স্যোসাল মিডিয়ায় দেখছি-
তোরা বৃটেনে বসে স্বদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিস 
একদল বিলাতি খানকির পোলারা।
আমেরিকায় বসে গাদ্দারী করছিস একদল মার্কিনী মাদার চোদে রা।
কানাডায় বসে নিমকহারামি করছিস একদল ভিকিংগাদের 
জারত সন্তান। অষ্ট্রেলিয়ায় নিউজিল্যান্ড জাপান কোরিয়া
দেশে বিদেশে রক্ত সঙ্কর বর্ণ সঙ্কর আর্যমার্য পাকি রাজাকার 
যে রক্তই তোদের রক্তের সাথে মিশে থাকুক না, 
আমাদের রক্ত মাথায় উঠলে, খোদার কছম, তোদের একটাকেও ছাড়বো না।
তোরা সব শুনে রাখ জেনে রাখ!
পাকিস্তানি হায়েনা কে আমরা ছাড়িনী,
রাজাকার আলবদর কে ছাড়িনী,
তোদেরকেও ছাড়ার প্রশ্নই উঠেনা।
সবাধান! হুষিয়ার! এখনও ধর্য্য ধেরেই আছি।
ধর্য্যচ্যুতি হলে একটিরও রক্ষা নাই।
শুন ধর্মের জল্লাদ বাহিনীরা শুন!
যে ধর্মে উগ্রবাদীতা হিংসা বিদ্বেশ শেখায়, 
সেই ধর্মকে আমরা ঘৃনা করি।
যে ধর্মে শেখায়না, সহিষ্ণুতা বিনয় নম্রতা ভদ্রতা 
সে ধর্মকে আমরা প্রত্যাখ্যান করি।
 যে ধর্ম বিধানে লেখা নেই সাম্য মৈত্রি, প্রেম ভালোবাসা,
 সে বিধানকে আমরা চিড়ে ফেলবো।
বোকা আর বিবেকহীন মানবতহীন মানুষেরা কোনদিন
ঈশ্বর প্রেমিক হতে পারেনা।
নির্মোহ সত্য আমরা জাতিকে জানিয়ে দেবো।
 তোমাদোর মুখোশ উন্মেচন করে দেবা।
ফাঁসি কিংবা এনকাউন্টারে তোমাদের মৃর্ত্যু আমরা 
নিশ্চিত করবোই করবো।
                              ১৮,০৪,২১, জার্মানী,

সব কিছু লিখে রাখছি ...



সব কিছু লিখে রাখছি নিপুন হাতে,  

আমার  এই ডায়েরিতে,
  আমার এই নষ্ট কলমে।
তোমাদের সকল জুলম অত্যাচার অবিচার,
কথা লিবো,অন্যায় অরিয়মের কথা  লিখছি,
তোমাদের নির্যাতন নিপিড়নের কথা লিখছি,
ভূক্তভোগি জাতিকে উসকে দিতে  লিখছি,
আগামি প্রজন্মকে সব জানিয়ে দিতে আমি লিখছি,
নিপুন হাতে, আমার ডায়েরিতে, আমার এই নষ্ট কলমে।

তোমাদের উশৃঙ্খল উন্মাদনার কথা আমি লিখছি।
হরতাল অবরোধ, মিছিল মিটিং জ্বালাও পোড়াও,
নিরীহ মানুষ হত্যা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা আমি লিখছি।
রাষ্ট্রিয় সম্পদের ধবংশ লীলার কথা আমি লিখছি।
রাজকোষের কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার,
ব্যাংক  লুট হরি লুট ঘুষ দুর্নীতি ভুমি দস্যুদের বিরুদ্ধে আমি লিখছি।
তোমাদের  অশুভ-আর অপশক্তির বিরুদ্ধে এটাই আমার মোক্ষম অস্ত্র।
তোমাদের রাক্ষস খোক্কোস দজ্জালের বংশকে ধংশ করেতেই আমি লিখছি।
তোমাদের ভাঁড়াটিয়া লাখো শ্রমিকের মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে 
প্রতিরোধ প্রতিহত করা আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়।
তাই বিস্তারিত লিখে রাখছি।
আমি ঘোট ঘোট অক্ষরে লিখে রাখছি,
তোমাদের সকল অপকর্মের কথা।
আমি লিখে রাখছি  ভন্ড লুইচ্ছা লাফাঙ্কা ধর্মব্যপারি মামুনুলের 
রিসোর্ট কান্ডের কথা।আমি লিখছি ধর্মের অপব্যখ্যা অপব্যবহারকারী 
ফতুয়া বাজদের কথা।আমি লিখে রাখছি, বোরকায় আবৃত নারীর 
অপমানের কথা। আমি লিখছি পায়জামা পাঞ্জাবি দাঁড়ি টুপির অপমানের কথা।
আশি লিখে রাখছি ইসলাম ও মুসলমানের অপমানের কথা।
আমি লিখে রাখছি তোমাদের সকল কৃতকর্ম গুলি।
এগুলি লিখে রাখা দরকার বলেই লিখছি।
কারণ আমি জানি তোমাদের সকল অপকর্ম নিয়ে একদিন সিরিয়াল নাটক
সিনেমা হবে।গল্প হবে, গান হবে, কত কবিতা আ-কবিতা রচিত হবে।
আমি জানি তোমাদের কাপুরষতা নিয়ে,
সারকেসের ক্লাউন বানর হনুমানের মত তোমাদের দাঁড়ি ধরে টানবে,
টুপি খুলবে, সেরোয়ানি চিঁড়ে তামাসা করবে।
আমি েলিখে রাখছি গাদ্দার রাজাকার আলবদর আলসামছের  ধংশলীলার কথা।
রগকাটা গলাকাটা রক্তাক্ত ধর্মের জল্লাদ বাহিনীর কথা।
 আমি লিখছি হেফাজতি হিজরাদের রাসলীলার কথা।
আমি লিখছি ওয়াজিদের যতসব আকথা কুকথা ভাওতার কথা।
এগুলি সব লিখে রাখা দরকার বলেই আমি লিখছি।
কমরে দুধার খঞ্জর,হাতে উঁচু করে তলোয়ার 
ঘোঁড়ির পিঠে চড়ে ওরা রণহুঙ্কার দিয়ে ঘোষনা করছে মানুষ জবাইয়ের।
মাদ্রাসা মক্তব গুলিকে ওরা বানিয়েছে গ্যারিশন, অস্ত্রের গুদাম।
প্রবিত্র পোষাক পড়ে ওরা করছে শিশু বলাৎকার।নারী শিশু নির্যাতন নিপিড়ন।
বলাৎকারী বাবাদের মুখোশ উন্মেচন করেতেই আমি লিখছি।
আমি লিখছি সমৃদ্ধির  শান্তিময় সমধিকার সমবন্টনের একটি বাংলাদেশের জন্যে।
আমি লিখছি সম্ভাবনাময় অনিয়ন্ত্রিত একটি স্বপ্নের বাংলাদেশের।
রক্তে দিয়ে নয় আমার এই নষ্ট কলমের কালি দিয়েই আমি লিখছি
বিপ্লবের নতুন ইতিহাস।
আমি লিখছি পরম শ্রদ্ধায় মাথা নত করে মমতাময়ি মহিষী 
নারীকে ভালোবেসে। 
                              ১৮,০৪,২১, জার্মানী,



Friday, April 16, 2021

১০ই মে বাবার বিদায় বেলার দিনঃঃ---



বাবা তোমাকে আজ আমার  মনে পড়ছে,খুব করে মনে পড়ছে। 
জানি তুমি আজ পৃথক পৃথিবীর একজন শান্তসিষ্ট বাসিন্ধা।
যত দুরেই তুমি থাকো না কেন,বাবা মায়ে রা তো সন্তানের মাঝেই বেঁচে থাকে অনন্তকাল ধরে।তুমিও বেঁচে আছ আমাদের মাঝে। আমাদের অন্তর আত্মায়।  যত দুরেই তুমি থাকো না কেন মনে হয় যেন ঔ দুর আকাশে প্রদীপ্ত একটি সন্ধ্যা তারার মত   তোমাকে আমি দেখছি। আমার অন্তর আত্মায় এসে পড়ছে তোমার নিহন আলোর বিকিরন, ঐ দেখা যায়,  সত্যিই তুমি ঝল ঝল করে জ্বলছো।

 ঐ দুরের  আকাশগঙ্গা কিংবা নিহারীকা কুঞ্জের কোন এক গ্রহ-গৃহের 
দর্জার সামনে রাতুল ভরা গ্লাস হাতে আরাম কেদারায় বসে  জোসনা রাতে
  উচ্চ শব্দে বার বার যেন তুমি কাউকে বকছো,যেমনি এই পৃথিবীতে থাকতে
প্রতি সন্ধ্যায় উঠোনে বসে বসে  পাইপ টানতে টানতে  বকতে- ঠিক তেমনি
বাবা তুমি বকছ ,এমনি করে--
জগতে  মিথ্যাবাদীরা সব কুত্তার বাচ্ছা,
উপকারের নামে ছোবাড় (চড়)
জীবনে কারো উপকার করতে নেই---
কুত্তার বাচ্ছারা সব দড়িবাজ, নিমক হারাম, শুয়োরের বাচ্ছারা সব কিছু ভূলে গেছে।
 এই মসজিদের পাশেই আমার বাবা-মা দুজনই চির নিদ্রায় শায়িত, এই মসজিদের জায়গাও আমার বাবা দান
করে গেছেন, আপনারা আমার বাবা মায়ের জন্য দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন তাদেরকে জান্নাত দান করেন, আমিন,



বাবা তোমার মুখে গালি গুলি শুনে শুনে আমরা সবাই  ঘুমিয়ে পড়তাম, আর নির্ঘুমে পোহাত 
প্রায় তোমার প্রতিটা দীর্ঘ দীর্ঘ রজনি।ভালো করে বুঝতাম না তুমি কাকে এমন কর্কশ ভাষায় গালি দিতে।
আমরা না বুঝলেও মা যেন সবি বুঝতেন।

বড় হবার সাথে সাথে আমরাও বুঝতে থাকি।  বাবা তুমি কাদেরকে এমন অশ্রাব্য  ভাষায় গালি দিতে?
তোমার অতি আপনজন, যাদের সাথে তোমার রক্তের সম্পর্ক,  আশে পাশের
 সেই  নিমক হারামদের তুমি গালি দিতে।ওরা নেড়ি কুত্তার মত নেতিয়ে বেহায়ার মত তোমার গালি শুনতো।কারুর মুখে কোনদিন রা শব্দ সরেনি।

কেন গালি দিতে? বড় হবার সাথে সাথে সে গল্প তুমি আমাকে শুনায়েছ অনেক বার।কোর্টের বারান্ধায় খেতের আলে বসে বসে অথবা হাঁটে বাজারে যেতে যেতে।কারণ আমিই তো ছিলাম তোমার একমাত্র হাতের লাঠি।যে সন্তান বাবার কোলে পিঠে বড় হয়ে বাবার হাতের লাঠি হতে পারে,তার চেয়ে সৌভাগ্যবান সন্তান জগতে আর কে হতে পারে।এ কথা ভাবতেই অসম্ভব ভালো লাগায় মন ভরে উঠে । বাবা নিশ্চয় আমি খুবি ভাগ্যবান।আমিই  তোমার সেই হাতের লাঠি সৌভাগ্যবান সন্তান।
বাবা আমি তোমার রক্তের সন্তান, আমি তোমার আদর্শের সন্তান।প্রতিদিন প্রতিক্ষন তোমাকে ধারণ করি,লালন করি অন্তর আত্মায়।জীবন চলার পথে প্রান্তরে, দুঁদে এই অলিতে গলিতে, আমার কালো কালো আকাশে, তুমি প্রতি প্রভাতে উঠো সোনালি  সূর্য্যএর মত, রাতে উঠো পুর্নিমার শশীর মত।তোমার আলোতে উদভাসিত হয়ে হাঁটছি এ জটিল পৃথিবীর আঁকা বাঁকা পথে, ছায়া পথ ধরে উহ্য কুকুরের মত।

বাবা তোমার মুখে শুনেছি তোমার জীবনের গল্প্টা--


সাত ভাইয়ের মধ্যে তুমি ছিলে তৃতীয়, আর আমিও হলাম চার ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয়, দেখ তোমার আমার মাঝে কি অসম্ভব মিল। মানে আমিও তোমার মত সংসারে সেঝ।তোমার একটি বোনও ছিল, আমাদের অদেখা পুফু।ছোট দু ভাইকে উলঙ্গ  রেখে তোমার পিতা না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তোমার বাবা মানে আমাদের দাদার নাকি কলিজার বিমার(ব্যদনা) ছিল।  ছোট একটি সনের ঘর( কুড়ে ঘর) তার ভিতরে তোমরা আট ভাই বোনকে নিয়ে তোমার বৈধব্যা মা, আমাদের প্রিয় দাদি, মাকড়সার মত এতগুলো সন্তানকে আঁকড়ে ধরে বড়ই হিমশিম খেত।ঝাউ আর ভাতের মাড় নিয়ে মারামারি  নিত্য দিনের ব্যপার ছিল তোমাদের সংসারে।রক্তাক্ত হত তোমাদের কুড়ে ঘর হাঁড়ি বাসনপাতি।আজ এর গাল ছুলত তো কাল ওর।টগবার বাড়িতে মাথা পাঠতো।নুন্যতম  বেঁচে থাকার এই নির্মম লড়াই সংগ্রাম তোমার সহ্য হতো না বিধায় একদিন গোপনে মাত্র বার বছর বয়সে তুমি হয়ে গেলে বিভাগী।তোমার কিশোর জীবনের সুন্দর সাম্পান ভাসিয়ে দিলে অন্তহীন মহা সমূদ্রে।

তোমার সেই সুসৌভিত সাম্পান তোমার স্বপ্নের বহু বহু পৃথিবী গুরে অবশেষে প্রাচ্যের পম্পে নগরিতে গিয়ে নোঙ্গার ফেললো।(সন্দীপ হাতিয়া সহ নোয়াখালীর উপকুল অঞ্চল নিয়ে সমূদ্র গর্ভে বিলীন হওয়া নোয়াখালীর আদি শহরকে বলা হয়েছে পম্পে নগর)নতুন দেশ নতুন শহর, নানা বর্ণের মানুষ জনে,নানা রঙের জাহাজ, তার উপর সাগরের উত্থাল ঢেউ এর সাথে আছড়িয়ে পড়ছে প্রাণের স্পন্দন।ভীষন খুদার্থ ছিলে তুমি।পকেটে তোমার একটি পয়সাও ছিল না।পকেট থাকবে কোত্থেকে? গায়ে তো জামাই ছিলনা। চেঁড়া একটি লুঙ্গি পরনে, গায়ে একটি চিন্ন চাদর পাঁ-জোড়া খালি।পেটে অকুতভয় ক্ষিদা, খুদার্থ কাকের মত গুরছো এদিক ওদিক।
অনেক খোঁজার পর অবশেষে কোন এক সুহৃদ খান সাহেবের কাপড়ের দোকানে মিললো তোমার একটা চাকুরি।তাও আবার পেটে ভাতে। বেতন ছিলনা।শুধুই বেঁচে থাকার লড়াই। অজানা অচেনা নগরে সেটাও বড় প্রাপ্য।চার পাঁচ বছর সেখানে থাকার পর পম্পে নগরি সাগর গর্ভে বিলীন হবার পুর্বেই তোমার জীবন সাম্পান নোঙ্গর তুলে আবার ভাসতে ভাসতে গিয়ে ভিড়লো কলিকাতার বন্দরে।সেখানে একটি দোকানে দুবছর চাকুরি করে দশটাকা জমিয়ে তুমি জাহাজের নলি বানিয়ে চাকুরী নিয়ে বিদেশী জাহাজে উঠে পাড়ি জমালে  সমূদ্রের পথে দিগ্বিজয়ি কলম্বাসের মত।পৃথিবীর পথে পথে বন্দরে বন্দরে, তোমার স্বপ্নের নোঙর ফেলে, উত্তর মেরু দক্ষিন মেরু প্রদক্ষিন করে অবশেষে বহুদিন পর ঘরে ফিরেছ।ধুমধামে  ঘরে তুলেছ আমাদের প্রিয়তমা মাকে।

বলা বাহুল্য তোমাদের বিশাল বংশে আমার মা-ই ছিল আরবি বাংলা জানা একজন শিক্ষিত মানুষ।মা যখন তোমাদের পরিবারে এসেছিল তখনও তোমাদের সনের একটি মাত্র ঘর ছিল।তখনও তোমাদের দারিদ্রতা দুর হয়নি।অভাব অনটন লেগেই ছিল।মায়ের মুখে শুনেছি তোমার ছোট দু ভাইকে মা এসে ন্যাংটা গোছল করাতো।মায়ের কাছেই তাদের লেখাপড়ার হাতে খড়ি হয়েছে।তাও আবার একজনের অন্যজন  তো মাস্তান হলো।  তখনও রক্তাক্ত হতো তোমাদের কুড়ে ঘর।ডাস্টবিনের উচ্ছিস্ট নিয়ে কুকুরেরা যেমনি করে।

মাকে রেখে কিছুদিন পরে তুমি তোমার তিন ভাইকে কলিকাতা নিয়ে জাহাজে চাকুরি দিয়েছ।বড় দুভাই কয়বছর চাকুরি করে আর  যায় নাই মাথা গুরার ওঝুহাত তুলে।ছোট এক ভাইকে নিয়ে দীর্ঘদিন ভেসেছো গভির অগভির সাগরের  অথৈ জলে।অনেক টাকা কামায়েছ দু ভাই মিলে, অনেক সম্পত্তি জোড়ায়েছ। কিন্তু সব  ভাইকে সমান ভাগ করে বেঁটে দিয়েছে। কিছুদিন পরে তোমার সেই ছোট ভাইটি আর যায়নি জাহাজে। তুমি একাই ভাসায়েছ তোমার স্বপ্নের সাম্পান।সেই ব্রিটিশ পিরিয়ড থোকে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ পিরিয়ডেও তুমি একাই ভেসেছ।

অনেক টাকা কামায়েছ অনেক সম্পত্তি জোড়ায়েছ।আশে পাশের মানুষেরা মনে করতো জাহাজে চাকুরি করে নয় তোমার কাছে গুপ্ত টাকা বানানোর মেশিন আছে।ঘরে বাহিরে উপছে পড়তো তোমার টাকা পয়সা। বাবা তুমি যত সম্পত্তি জোড়ায়েছ, আজ আমরা চার ভাই ইউরোপ আমেরিকা থেকেও এত সম্পত্তি জোড়াতে পারিনি।এক জীবন প্রায় শেষ ।আমরা চার ভাই তোমার খরিদা সম্পত্তিতেই বাড়ি করেছি।

 বাবা তুমি তো দেশ দেশান্তরে ছুটে বেড়াতে, দরিয়া দরিয়ায় ভাসতে। এদিকে মা একা বাড়িতে ছোট ছোচ সন্তানদেরকে আগলে ধরে বাড়ি থাকতেন। মায়ের মুখে শুনেছি তিন বার আমাদের ঘর ডাকাতি হয়েছিল। মুখোশ পড়ে তোমার ভাইয়েরাই  নাকি ডাকাতি করেছে। মায়ের চিতকারে অন্য বাড়ি থেকে লোক এসে ডাকাত দৌড়ায়েছে, কিন্তু তোমার হিংসুটে ভাইয়েরা কেউ আসেনি। মা বলেছেন নগদ টাকা পয়সা সহ সেরে সেরে সোনারুপা ডাকাতেরা নিয়ে গেছে।

বাবা তোমার ছোট যে ভাইকে তুমি লেখা পড়া শিখায়ে মোক্তার বানাতে চেয়েছ, সেই ভাইটিই আমাদেরকে বেশি হিংসা করেছে।মোক্তার তো হতে পারেনি তিনবার মেট্রিক দিয়ে ফেল হরে কৃষ্ণ স্যারের মুখে শুনেছি। মোক্তার তো হয়নি সে হলো বর্ডার গার্ড।ভূয়া মুক্তি যোদ্ধা। বাবা সাতাত্তর সালের দিকের কথা একাবার মিন্টু আমাদের চরের দুদাগ জমিন  চাষ করেছিল। ধান যখন পেকেছিল তখন তোমার সেই হিংসুটে ভাই মুক্তি ফোজের অস্ত্র তাক করে আমাদের দুদাগ জমিনের ধান কবিরা হাওলাদের সাথে মিলে লুটায়ে দিয়েছে।সে সময় তুমি না কষ্ট পেয়েছ। আর আজ সে ভাইয়ের সন্তানরাই ্ একি কায়দায় তোমার বাবার সম্পত্তি ও তোমার কেনা সম্পত্তি জোর করে দখল করে রেখেছে।তারা এখনও দেখ কেমন ভাবে খুনের নেশায়  মেতে উঠেছে।

  বাবা তুমি আমার বাড়িটা দেখে গেছ। আমি যে তোমাকে বলেছিলাম তোমার চার ছেলেরা  একদিন বড় বড় বাড়ি করবে। দেখ আজ তোমার সনানেরা তোমার জায়াগায় উঁচু উঁচু বাড়ি করেছে। তোমার মসজিদের জন্য দান করা জায়গায় আজ বিশাল মসজিদ হয়েছে।  আর তুমি চলে গেছ ও পারে খালি হাতে সাড়ে তিন হাত জায়গা লয়ে, শুয়ে আছ মসজিদেরই পাশে। ভালো থেকো বাবা সে পাড়ে।



                                                         .....ফারুক, জার্মান প্রবাসি,


Friday, March 12, 2021

একটি গাধার সন্ধানে আমি---


প্রিয় মাইজদী বাসি; আমি একজন প্রবাসি। খুবি শিঘ্রই দেশে ফিরে আসছি।আমার একটি গাধার জরুরি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।আমি উপযুক্ত দাম দিয়ে একটি স্বদেশি গাধা কিনতে চাই।অবশ্য গাধি হলেও চরবে।
বাঙ্গালীর কাছে গাধা আর গাধির কাছে পার্থক্য কি? স্টেনগান আর মেশিনগানকেও তো তারা দোনালা বন্ধুক মনে করে।পিস্তল আর রিভেলবারের পার্থক্য তো দুরকি বাত।
যে ভাই জন্তুটির সন্ধান দিতে পারবেন; অবশ্যই তাকে পুরুষ্কিত করা হবে।
গাধাটি অবশ্যই আমি কিনবো।যতই দাম চুকাতে হয় আমি চুকাবো। প্রয়োজনবোধে জীবনটাকে বাজি  ধরবো গর্ধব বাসীদের সাথে; তবুও আমি গাধাটি কিনবো।

আমি সে গাধাটিকে সাবান সেম্পু দিয়ে গা গোসল ধোওয়ায়ে; আতর পারফিউম মেখে; ভালো করে সাজায়ে গুছায়ে দু কান টেনে ধরে পিটে বসে পুরো মাইজদী শহরটা প্রদক্ষিন করতে চাই।সাগর কন্যা মাইজদীর অলিতে গলিতে গুরেফিরে দেখতে দেখবো।
প্রথমে মাইজদী পৌর ভবনের সামনে যাবো, বড় বিনয় ও শ্রদ্ধার সাথে মেয়র সাহেবকে লম্বা একটা সালাম জানাবো।তারপর আমি যাবো সুধারাম মডেল থানার সামনে। শ্রদ্ধেয় ওসি এসআই টিএসই সাহেবকে সহ সকল স্টাপকে সেই একি রকমের গর্ধবি সালাম জানিয়ে সিদা নির্বাচন অফিসের পাশে দিয়ে বড় দিঘীর পাড়ে পাড়ে গুরবো কিছুক্ষন। তারপর একটা দির্ঘ নিঃস্বাস চেড়ে আমরা দুজন রেজেষ্ট্রি অফিসের দিকে যাব। সেখানে আমরা দলিল বিশারদদের ভিড় ভেঙে গিয়ে পেশাব পায়খানা সেরে মুনসেফ কোর্টের সামনে গিয়ে গর্ধবি সালাম জানিয়ে সিদা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো।খুব বিনয়ের সাথে তাকেও সালাম গর্ধবি সালাম জানাবো।

তারপর বড় দিঘীর পুর্ব পাশে দিয়ে সিদা গিয়ে প্রেস অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো।সেখানে সালাম নয় নাম ধরে ধরে কয়টা সংবাদিকের মা-বোনকে বিশ কোটিবার গালি দিবো, বাংলা ইংরেজি আরবি কিছই বাদ থাকবেনা।তারপরে যাবো বার লাইব্রেরি হয়ে সিদা জর্জকোর্টের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো।সেখানে আমরা শ্রদ্ধায় মাথা নত করে উকিল মোক্তার বারিষ্টার আর জজ সাহেবকে লম্বা একটি গর্ধবি সালাম জানায়ে জজ কোর্টের ভিতর দিয়ে যেখান দিয়ে সাজাহান একরামের কামলাগুলো দল বেঁধে যাতায়াত করে ঠিক সেখান দিয়ে গিয়ে জুডিসিয়াল ম্যিাজিষ্ট্রেট আদালতের সামনে গিয়ে বেশ কিছুক্ষন দাঁড়ায়ে থাকবো, তারপর কোন জজ ম্যাজিষ্ট্রেট নয়, ভবনটিকে লম্বা একটি সালাম জানিয়ে সিদা বড় মসজিদের সামনে দিয়ে মাইজদী শহর টাকে গুরে ফিরে দেখবো।
পরিশেষে ক্লান্ত হয়ে মাইজদী শহরের অরুচিকর নাম করা কোন হোটেলে বসে গর্ধবদের সাথে বসে লাঞ্চটা সারবোেআর গান্ধা নালি নর্দমার গন্ধগুলি নাকে লাগাবো আতরের মত।


                ------চলবে,  

Tuesday, March 9, 2021

রাজনৈতিক দুনিয়ায় হত দরিদ্র কয়জন ভিখারী,


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইতিহাসে বেশ কয়জন হত দরিদ্র ভিখারী।যারা বর্তমানে বাজারে জেলের ঢালার টেংরা মাছের মত একুল ওকুল হারিয়ে শুধু কেঁতুর কুঁতুর করছে।


অবশ্য জামাতি বামাতি অনেক নেতা দল বদল করে বিএনপিতে যোগ দিয়ে ভীষন লাভবান হয়েছে।বার বার এমপি নির্বাচিত হয়ে কেউ কেউ মন্ত্রি মিনিষ্টার ও হয়েছেন।গাড়ি বাড়ি কাড়ি কাড়ি টাকার মালিকও হয়েছেন।
হত দরিদ্র ভিখারী হয়েছেন, যারা আঃলীগ ছেড়ে অন্য দলে গেছেন।রাজনীতির আবর্জনার স্তুপে গান্ধা নর্দমার পাশে তাদের বসবাস।তবু তারা এখনও টকশোতে বসি দুর্গন্ধ চড়াচ্ছে।তাদের তালিকা খুবি দীর্ঘ।ডাকসুর ডাক সাইটে নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না, সুলতান মনসুর, হাবিবুর রহমান হাবিব, আ.স.ম রব, সংবিধান প্রনেতা ডঃ কামাল হোসেন, ডঃ আবু সায়িদ, টাইগার কাদের ছিদ্দিকী, মহসিন মন্টু, আয় হায় রে কত বড় মাপের মানুষ আজ বুঝি বাজারের গোল আলুর মত পঁচে গেল।

এক কুস্তিগীরকে প্রতিপক্ষ মাটিতে চিৎ করে পালায়ে  দশবার বুকের উপর উঠে বসলো, পরাজিত কুস্তিগীর দশবারই টাং উঁচু করে বললো আমার ঠাং উপরে আছে, সুতরাং আমি হারিনী। সেই রকম অবস্হা আর কি।

এই সব ভিখারীদের দল নেতা হলেন, জনাব ডঃ কামাল হোসেন।সন্মানী ব্যক্তি, বিশষ্ট আইনজ্ঞ ব্যক্তিও।আবার বিতর্কিতও কম নন।তিনি কয়দিন একেবারে চুপ থাকেন, আবার হঠাৎ করে একটা মণ্হব্য করে আলোচিত সমালো্চিত হন। তিনি জবাব টেবাব দেন না।








Thursday, March 4, 2021

,,নূর গ্রহ”


                                                                                    







                              ,,নূর গ্রহ”
                                     ----বাই নুর হোসেন ফারুক,





আমার কথাঃ--এই গল্পটা বাস্তব ও সত্য ঘটনা অবলম্বনে  লিখা শুরু করছি।মূলত সৃতিচারন মূলক,ঘটনাবলির
আবতারনা করছি,পুরোটাই জীবন থেকে নেওয়া।এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের জীবনটাই একটা গল্প, ইংরেজ সাহিত্যিক সেক্সপিয়ার বলেছেন পৃথিবীটা একটা রঙ্গমঞ্চ, আর মানুষের জীবনটা এক একটা নাটক।আসলেও তাই।নাটক সিনেমার প্রতিটি স্ক্রিপ্ট মানুষের জীবন থেকেই নেওয়া। কেউ লিখে দেখে কেউ লিখে শুনে আর কেউ লিখে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকেে।আমার শিশু ও শৈশব কালের প্রত্যক্ষ দেখা এবং অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত ঘটনাবলিই লিখলাম।লেখার জন্য ও একটা পাকা হাতের দরকার।সাথে সাথে একটা স্পর্শকাতর মনেরও দরকার। চাইলেই যে কেউ লিখতে পারেনা।কাঁচা হাতে একটা দ্বায়বদ্ধতা থেকে লিখেছি।কেমন হলো তার বিচার পাটকের হাতে।

-----নুর হোসেন ফারুক,

  







                                                         (এক)

ত্রিশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া সে মেয়েটির নাম ছিল নূর গ্রহ। 

আমাদের এই হরিৎ পৃথিবীকে আমরা কেউ আদর করে ডাকি নীল গ্রহ, আবার কেউ ডাকি বিশ্ব, কেউ ডাকি পৃথিবী কেউ ডাকি বসুমতি বসুন্ধরা ইত্যাদি কত কত নামে।

বিগব্যাং থিউরিতে বলে মহা বিস্ফোরনের ফলে প্রথমে হাইড্রোজেন গ্যাস পরে হিলিয়াম গ্যাস থেকে প্রথমে নক্ষত্র তার পরে গ্রহ উপগ্রহ চাঁদ সুরুজ ও সকল জীবের বাসস্হান আমাদের এই পৃথিবীর সৃষ্টি। যাক সেটা অন্য প্রসঙ্গ।আমরা আগে শুধু নূর গ্রহের ব্যপারে কিছু শুনবো।

ঠিক তেমনি মেয়েটির বাবা-মা তার নাম ওরিয়েন্টেরি স্টাইলে রাখলেও আমি তার বাংলা নাম দিয়েছি নূর গ্রহ”বা নুরের দেশ।

 তার ও নাম এখুনি বলছিনা কারণ, না জানি বদনাম হয়ে যায় কিনা।অবশ্যই তার আসল নাম বলবো একটু পরে।এখন থেকে সুবিধার্থে  নূর গ্রহ মেয়েটিকে  আমি সংখেপে ডাকবো নোরা বলে।

মাত্র মাস কয়েক আগে বিবাহিত  নাদুস নুদুস  চেহারার উজ্জল শ্যামলা বর্ণের মেয়েটি প্রথম বারের মত পিত্রালয়ে নায়রি হিসেবে এসে হঠাৎ করে পাগলপনা শুরু করে দিল। এর কারণ কি? কেন মেয়েটি পাগল হয়ে গেল?পুরো বাড়ির মানুষেরা সবাই হতবাক!

 তখন আমি নিতান্তই কোলের ন্যাংটা শিশু।বাড়ির বড়দের কোল বুক পিট ছিল তখন আমার দুদন্ড শান্তির ঠিকানা ।

সৃষ্টির উৎসয়ের নামই হলো সৃষ্টিকর্তা।আমরা যাকে আল্লাহ বা ভগবান বলে থাকি।বহুগুনের অধিকারিকেই ভগবান বলা হয়।আল্লাহ পাক এই পৃথিবীর সবকিছুই সৃষ্টি করেছেন বড়ই নিখুঁত ভাবে।নবী মোহাম্মদের অনবদ্য সৃষ্টির নামই আল্লাহ।ইলাহ থেকেই নাকি আল্লাহ নামের উৎপত্তি।আর ইলাহ নাকি বাক্কা শরিফের ৩৬০ মুর্তির প্রধান টির নাম।আল্লাহ নামের অর্থও হলো সর্বশক্তিবান, তিনি ইলাহার ও বড় কেউ বা বড় স্বত্বা।সে যাই হউক, আল্লাহ আছেন কিবা নাই মানব কুলে সংশয় বা দ্বিধা থাকতে পারে, কিন্তু মুসলমান হিসেবে বিশ্বাস করি।  আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে বিন্দুমাত্র ভূলভ্রান্তি ধরার ক্ষমতা কোন মানুষের নেই।আল্লাহ মানুষকে সেই ক্ষমতা দেননি।

এই বিশাল কিশ্ব ভ্রম্মান্ডের বিরাট সৃষ্টির মাঝে একজন মানুষ খুদ্র থেকে অতি খুদ্রাকার একটি অনুকণা মাত্র। যা অনুুবিক্ষন যন্ত্র দ্বারা দেখাও কষ্ট সাদ্য।  তবুও মানুষের অহঙ্কার হয় ভয়ঙ্কর।  

ইংরেজিতে একটি কথা প্রচলিত আছে, নো বডি ইজ পারপেক্ট।সেটা বলার প্রয়োজন নেই । জীবন চলার মাঝে শিক্ষিত কিংবা সাধু পন্ডিত প্রতিটি মানুষই ভূলভ্রান্তি করে থাকে।অথবা নিজের অজান্তেই ভূল হয়ে যায়।ভূল থেকেই মানুষ শিখে।

পৃথিবীতে নিখুঁত কোন মানুষ নেই নিখুঁত কোন পরিবার নেই, নিখুঁত কোন প্রেম ভালোবাসা নেই, নিখুঁত কোন সম্পর্ক নেই, নিখুঁত কোন সংসার নেই।স্বচ্ছতাহীন গোলা পানিতে প্রতিনিয়ত আমরা শুধু হাবুডুবু খাচ্ছি।এটাই নিত্য সত্য।সুতরাং এই সব নিয়ে অযথা হা হুতোস দুঃখ ব্যদনা বা কষ্ট পাওয়ার কোন মানে হয় না।এই পৃথিবীতে মানুষ বাঁচে শুধু একবারই।বাঁচতে হলে ওসব মন মস্তিস্কো থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে।

মহান আল্লাহ পাক মানুষকে তিনটি অসিম ক্ষমতা বা শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। সেটা হলো, এক, সৃতিশক্তি, দুই, কল্পনা শক্তি, তিন বুদ্ধিমত্বা শক্তি।

এই তিনটি শক্তির উৎসহক্ষেত্র হলো মানুষের মন।ইংরেজিতে যাকে বলে মাইন্ড।মনকে আবার দুভাগে ভাগ করা হয়, যেমন কনসেন্স মাইন্ড, এবং আনকনসেন্স মাইন্ড, যাকে বাংলায় বলে অবচেতন  এবং চেতন মন।এই পৃথিবীতে মানব জাতির নয়নোভিরাম দৃষ্টি নন্দন সকল অনবদ্য সৃষ্টির প্রথম খসড়া স্হল হলো মানুষের মন মস্তিষ্কো।কত শতবার ড্রাপ ড্রয়িং কাটাচেড়ার খসড়া প্রথম হয়েছে মানুষের মন মস্তিষ্কে।মানুষের মস্তিষ্কের আবর্জনা দিয়ে এই পৃথিবীকে দশ লক্ষ কুটিবার ডেকে দেওয়া যাবে।হয়তো বা তারও বেশি।

কি হে বন্ধু  কি ভাবছো? শুধু  কি এক বারেই  এই স্কাই লাইনের উঁচেল দালান গুলো সৃষ্টি হয়েছে? এই টুইন টাওয়ার সিয়ার্স টাওয়ার এই এম্পেয়ার বিল্ডিং, পেট্রোনাস টাওয়ার বুর্জ খালিফা, আইফেল টাওয়ার, এই মক্কা মদিনার প্রথম খসড়া তৈরিও হয়েছে মানুষের মন মস্তিষ্কেই।

কৃষকের মস্তিষ্কের আবর্জনা যদিও গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়, কিন্তু এই যুগের রাজনীতিবিদ শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবিদের মস্তিষ্কের আবর্জনা কুকুর শুকুরের খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা যায় না। তবু ওদের দাম্ভিকতার কমতি নেই।

 সে নোরা নামের পাগলি মেয়েটির তান্ডবে যখন বড় বাড়ির বড় রা সবাই আতঙ্কগ্রস্হ। পৌষের জাপরানি সকালটাকে যখন ভয়াবহ ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিল, তখন এই আমি সেই দানবি মেয়েটির কোলে  বসে দিব্যি দেখছি পরিস্হিতি এবং দুরের দিগন্ত আর পারিপার্শিক পানোরমাকে।

সেদিন মেয়েটির পাগলপনায় আমার শিশুতোস সৃতিশক্তিকে শান দিয়ে আরো তীব্র ধারালো করে তুলেছে।সেই ধারালো সৃতির খঞ্জরে প্রতিনিয়ত আমি কেটেকুটে তছনছ হচ্ছি বিদায় নিঃশেষ হবার পূর্বে এই লেখার প্রয়াস করছি।কোন প্রকার প্রতারণা বা কল্পকাহিনী নয়। বাস্তব একটি সত্যনিষ্ট ঘটনা।

নোরা মেয়েটির কাছে আমি চির ঋনি ও চির কৃতজ্ঞ।এ কথা মু খুলে আমি কোনদিন তাকে বলতে পারিনি। কোথায়? সেই নোরা নামের মেয়েটি আজ কোথায়? ত্রিশ বছর হয়ে গেল সে আজও নিরুদ্দেশে লাফাত্তা ! স্বামি সংসার সন্তান চেড়ে সে আজ কোথায়? আমি হন্যে হয়ে খুজছি তাকে পৃথিবীর পথে পথে, নূর গ্রহে গ্রহে!

তার এতিম সন্তানদের এই বলে এখনো আশ্বস্ত করছি যে তোমাদের মা এখনো বেঁচে আছে।শিঘ্রই তোমাদের মা তোমাদের কাছে পিরে আসবে। তোমরা কেউ কেঁদনা এতিমের মত।যদি না আসে আমি শিগ্রই তোমাদেরকে নিয়ে যাব তোমাদের মায়ের কাছে।ওরা দিশেহারা হতাশ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। দুচোখ তাদের মোটা মোটা জলে চল চল।

রাষ্ট্রহীন দেশের নাগরিকদের মাঝে যেই বেদে বা বানজারান ভাব পরিলক্ষিত হয়।নোরার  সন্তানদের মাঝে সেই বৈদিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট আজ সুস্পষ্ট।নোয়াখাইল্যা ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, চেঁইরইয়া গুনের বেঁইরইয়া লাদা, অনেকটা সেই রকম। ধরাকে তারা সরা মনে করে না।অনৈতিক কাজেই তারা সদা লিপ্ত।বিদ্যা বুদ্ধিতে তাদেরকে কিছুতেই বুঝানো যাচ্ছেনা।তারা হলো কেউ আধা পাগল কেউ হলো পুরো পাগল।একজন তো এখন মাইজদীর নামী দামী চৌদ্দ নাম্বার ভূয়া সংবাদিক।আরেকজন প্রতারক কবিরাজ।আরেকজন এখানে ওখানে গুরে বেড়ায়।আরেকজন সন্ত্রাসী বনেছে।নব্য সন্ত্রাসী!

সত্য বলার পক্ষে এই আমাকে তারা কেন সত্রু ভাবছে ভেবেই কুল পাচ্ছি না।আমি তো তাদের হক আদায় করে দেওয়ার জন্য স্বস্ফূর্ত প্রত্যয়ে এক পাঁয়ে খাড়া।তাদের মত এই পৃথিবীতে আমিও তো বড়ই একা অসহায়, এতিম।তারা যে রকম মাকে হারিয়েছে, বাবাকে হারিয়েছে, আমি ও তো ঠিক সে রকম বাবা মাকে হারিয়েছি।সাথে হারিয়েছি একজন বড় বোনকে। তাদের থেকে একজন বেশি।এই নশ্বর পৃথিবীতে তারা যেমনি খালি হাতে এসেছে, আমিও ঠিক তেমনিই এসেছি।আবার সবাই খালি হাতেই চলে যাব।এটাই নিত্য সত্য।


                                                          (দুই)

নোরার তখনও কোন সন্তানাদি হয়নি।

তার  চাচাতো বোন মাতৃ বিয়োগ রাজিয়ার বিয়েতে তাকে বিশেষ ভাবে স্বামীসহ নায়রি আনা হয়েছিল।বিশেষ নায়রি বলছি এই কারণে নোরা মেয়েটি ভালো নাচতে এবং গাইতে পারতো।তাছাড়া নোরা এবং রাজিয়া প্রায় সম বয়সি ছিল।   রাজিয়ার ঘরে তখন সৎ মা।রাজিয়া ও তার এক ভাইকে রেখে তার মা হঠাৎ করে মারা যান।সেটাও ছিল এক রহস্য জনক ঘটনা।

রাজিয়ার আপন মা ছিলেন আবার নোরার মায়ের আপন মামাতো বোন।নোরার মা-ই ওকালতি করে দেবরের কাছে তাঁকে বিযে দিয়েছিলেন।নোরার মায়ের আরেক মামাতো বোন নোরাকে ওকালতি করে তাঁর দেবরের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। নোরার সেই স্বামীর নাম ছিল শাহ আলম।তিনি এন এস আই তে চাকুরি করতেন। পরবর্তিতে প্রমোশন পেয়ে অফিসার ও হয়েছেন।তাদের বাড়িটা ছিল বর্তমান মাইজদী বাজারের ঠিক উত্তর দিকের বাড়িটা। মজিদ হাজির বাড়ি নামে খ্যাত।

মজিদ হাজি ও চৌধুরী মিঞা, তারা ছিলেন দু সহোদর। সহোদর হলেও তাদের দুজনের গায়ের রঙ ছিল আলাদা।মজিদ হাজি ছিলেন সুন্দর ফর্সা,আর চৌধুরী মিঞা ছিলেন কালো বর্ণের দেখতে মাড়য়ারিদের মত। নোরার স্বশুরের নাম ছিল চৌধুরি মিঞা।চৌধুরি মিঞার  ছিল দু সংসার। প্রথম সংসারের একমাত্র সন্তান ছিল নোরার স্বামী শাহ আলাম।শাহ আলমের মা একটু সিদা সাদা  টাইপের ছিল বিদায় চৌধুরি মিঞা অন্য একটি বিয়ে করে আসামে পাড়ি জমান।সিদা সাদা একটু ভোলাবালা হলেও যতদুর জেনেছি তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা।

প্রচুর ধন সম্পদ জায়গা জমিনের মালিক থাকা সত্বেও চৌধুরি মিঞা সব কিছু ছেড়ে কেন আসাম চলে গেলেন তা আজো আমার বোধগম্য নয়।এই চোধুরী মিঞা দীর্ঘ চব্বিশ বছর পর আসাম থেকে ছয় সাতটা ছেলে মেয়ে নিয়ে একদিন হঠাৎ করে বাড়ি ফিরে এসে কি সুন্দর নোরার দুর্বিণীত জীবনকে দুর্বীসহ করে তুললো। তার সংসারকে ভেঙে তছনছ করে দিল।সে ব্যপারে বলবো ঘটনা প্রসঙ্গে সামনের দিকে।

চৌধুরি মিঞার প্রথম সংসারে একমাত্র ছেলে শাহ আলম পিতার অনুপুস্হিতে এত ধন সম্পদ রেখে কেনই বা পুলিশের চাকুরিতে যোগ দিলেন, সেটাও আমার আজো বোধগম্য হয়নি।কথাই বলে না কারো বুঝ কারো তরমুজ।

নোরার ছিল সুখি সংসার।বাগান ভর্তি ছিল হরেক রকম ফলপ্রুটের গাছ গাছালি, খেত ভরা ছিল সোনার ফসল।জায়গা জমিন বর্গা দিয়ে যে আধা ফসল ঘরে তুলতো, তাও বিক্র করে দিতে হতো, খাবার লোক ছিলনা।ঘরে রাখার জায়গা ছিলনা।  হঠাৎ করে নোরার জীবনে নেমে এল দুর্বীসহ দুঃসময়।

হাসি খুশি সুখ সাচ্ছন্ধ্যে ভরা ছিল নোরার সংসার।লাবণ্য এবং মাধুর্যময়ি নোরার  স্বামীটাও ছিল  মাটির মানুষ।দুজন মানুষের জুড়ি যেন বিধাতা স্বয়ং বেঁধে দিয়েছেন।আজো আমার হৃদয় দর্পনে ভেসে উঠে তাদের যুগোল ছবি।কি অদ্ভুত অসাধারণ মানুষ ছিলেন দুজনই। শৈশবে আমাকে দুজনই কি অসম্ভোব ভালোবাসতেন, আদর স্নেহ করতেন, চকলেট বিস্কুট কিনে দিতেন।তাদের কথা মনে করে এই মূহুর্ত্যে আমার চোখের জলে সমগ্র পৃথিবী কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা হয়ে উঠেছে। দুর দিগন্তে কিছুই ঠাওর করতে পারছিনা।

অতচ আমার সেই ভালোবাসার মানুষ দুজনকেই আমি বড় হয়ে নিজ হাতে মেরেছি।বার বার অপমান করেছি। ভীষনভাবে মেরেছি।সেই কথা মনে করে আমার এই পাপিষ্ট হাত দুটিকে কেটে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কেন মেরেছি সেই প্রশ্নের উত্তর দেব পরে ধর্য্য ধরুন প্রিয় পাটক  অগ্রাহ্য করবেন না প্লিজ। এমন ঘটনা আপনার জীবনেও ঘটতে পারে হয় তো বা ঘটেছেও?

নোরা অত্যান্ত ভালো মেয়ে। সুস্রি ভদ্র নম্র, লাবণ্য বলতে যা বুঝায়, সব গুনাবলিই তার মধ্যে ছিল। সারা রাত রাজিয়াদের ঘরে নাচগান খাওয়া দাওয়া করে হটাৎ করে সকাল বেলায় পুরো বাড়ির উঠোন ঝাড়ু দিতে দিতে সবাইকে গালিগালাজ করতে লাগলো, আবার কাউকে কাউকে লাঠিসোটা হাতে মারতে দৌড়া্চ্ছে।মাঝে মধ্যে নাচছে গাইছেও। বাড়ির বড়রা সবাই আতঙ্কিত এবং হতবাক!

আমার আতঙ্কটা কান্নায় রুপ নিল।আমি কাঁদছি ভয়ে শাহসে, সে কি ভয়ঙ্কর কান্না। সেই শিশু আমাকে পাগলি মেয়ে নোরা কোলে তুলে আদর করতে লাগলো। আমার দুগালে ঠোঁটে কপোলে সে কি আদরের চুম্বন।অতি আদরে আমি বিরক্তি বোধ করছি। কিন্তু কি করার।পাগলি মেয়ে আমাকে গলা টিপে মারতেও পারে, আবার আচারও মারতে পারে।অনেক দিন পরে মায়া নামে আরেকটি কোলের শিশুকে নোরা আছার মেরেছেও।পাগলরা হয়ও ভয়ঙ্কর!

বাড়ির সবাই কিংকর্ত্যব্যবিমূঢ়! কি হলো রাজিয়ার বিয়েতে তো আরো অনেক বেটি বৈতালি নায়রি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিল। কারোরই কিছু হলো না অতচ নোরা কেন এমন করছে?কি হলো নোরার?

 সবার চোখে মুখে একি প্রশ্ন।  সবাই কহাবলা করছে। কেউ বলছে ভূতে পাইছে, কেউ বলছে জ্বীনে, আবার কেউ বলছে পরীতে পাইছে নোরাকে।আবার কেউ বলছে রাজিয়ার সৎ মা হিংসা করে সিলের গোশতো খাওয়ায়ে দিয়েছে। কেউ বলছে ধুতরার ফুল খাওয়ায়ে দিয়েছে কেউ বলছে গোটা। ধুতরার ফুল আর গোটা খেলে নাকি মানুষ পাগল হয়ে যায়।ওসব আমার কিছুই জানা নেই।মানুষ কহাবলা করছে।নোরার কথা কেউ সৃতিচারন করতে গেলে আজো মানুষ বলে রাজিয়ার সৎ মা কিছু খাওয়ায়ে দিয়েছে।আল্লাহ মালুম!

নোরা পাগল প্রলাপ বকছে এই বলে, তোদের এখানে বড় বড় দীঘি হবে, খাল হবে রাস্তা হবে গারদ হবে ইত্যাদি।আবার এই ও বলছে তোদের সবাইকে আমি বাদশা বানিয়ে দেব।ছলি এ আমাকে টাকার পাতিল সোনা গয়নার বড় বড় সাতটা পাতিল সাধছে। আমাকে বলছে বাদশা বলে।বলছে তোকে আমি বাদশা বানিয়ে দেব। তোকে দেব সাত রাজার ধন। তুই হবি বিরাট বড় বাদশা।কান্দিস ক্যারে তুই। তুই হবি সাত মুল্লকের বাদশা, হাঃ! হাঃ ইত্যাদি।

নোরার পরে মা ও আমাকে এক সময় বাদশা বাদশা বলে ডাকতে শুরু করেছিলেন।

 দেখতে দেখতে  পাগলি মেয়ে নোরার প্রতিটি কথাই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সত্যিও বাস্তবে প্রতিপলিত হলো। 

 উন্নিশ সাতষট্টি কিংবা আটষট্টি সনের দিকের কথা।উত্থাল পাত্তাল তখন অখন্ড পুর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশ।সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙ্গালী বাঙ্গালীর পথের দিশারী হয়ে প্রমিউথিউসের মত আবির্ভাব হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমান।পাকিস্তানী বর্বরদের দুঃশাসন বাঙ্গালী কোন ভাবে মেনে নিতে পারছেনা।নবজাগরণে নব চেতনায় নব উদ্যোমে বাঙ্গালী এককাট্টা।স্বাধীনতা স্বাধীনতা! হয় জান না হয় মায়ের মান! রাখবো ইনশাল্লাহ।

অখন্ড পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ূব খান ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের উন্নতির লক্ষে নানা প্রকার কর্মযজ্ঞ শুরু করে দিল।সাথে সাথে নানা ফন্দিফিকিরও শুরু করে দিলেন।তিনি বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গনতন্ত্র নামে গনতন্ত্রের একটি নতুন সংজ্ঞাও উপস্হাপন করলেন।

  সে সময় মাইজদী শহরে একটি জেলখানা পুলিশ লাইন থাকা সত্বেও পশ্চিম মাইজদীর মানুষের চৌদ্দ পুরুষের ভিটে মাটি এবং ফসলি জমিন নামে মাত্রে মূল্যে হুকুম দখল করে নতুন করে জেল খানা পুলিশ লাইন হাসপাতালের নির্মান কাজ শুরু করে দিলেন।অবোধ নির্বোদের মত গ্রাম বাসী চুপ থাকলো।বাপ দাদার ভিটে মাটি চেড়ে গাট্টিগোট্টা বেঁধে উদ্ভাস্তুর মত অন্যত্র চলে গেল।এক বাড়ির মানুষ একশ বাড়িতে ভিবক্ত হলো। অনেকটা পাক ভারতের বিভাজনের মত।যে ভিবাজনে নাকি দশ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল।উদ্ভাস্তু হয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ।জাতীয় নেতাদের মাঝে নূন্যতম দুরদর্শিতা ও প্রজ্ঞা বলতে কিছুই ছিলনা। কি নেহুরু, কি জিন্না, কি গান্ধি!  উন্নতি এবং সভ্যতার আড়ালে এটাই বুঝি বর্বরতার বহিপ্রকাশ।

সে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।ইয়া বড় খাল ইয়া বড় দীঘি, ইয়া বড় রাস্তা ঘাট গারদ বড় বড় ইমারত দালান কোঠা। মাইজদীর মানুষ এই প্রথম বারের মত দেখছে।প্রতিদিন হাজার হাজার মাঠিয়াল পিপড়ারর মত দল বেঁধে এসে মাটি কাটছে। প্রসাড়িত হলো মাইজদী শহর।

তা- হলে নোরা মেয়েটি কি গায়বি কিছু জানতো? তা না হলে কিভাবে নোরার অগ্রিম বলা সব কথা সত্য হলো? হয়তো বা জানে।অনেকে এও নিয়ে কহা বলা করছে।

 প্রায় এক ধরনের  রাতারতি সব কিছু তৈরি হয়ে গেল।অনেকটা উড়ো দীঘির মত। বেগম গঞ্জের বানাবাড়িয়া নামে গ্রামে একটা বিশাল উড়ো দিঘী আছে।ফাঁকা জায়গায় দিনে মানুষ গরু চরায়ে গেল, পরদিন গরু চরাতে এসে দেখে সেখানে বিরাট একটা  দিঘী হয়ে  গেছে।পাহাড়ের মত উঁচু উঁচু দীঘির পাড়।রাতাতি হয়েছে বিদায় সে দীঘির নাম হলো উড়ো দীঘি।কল্প কাহিনীর মত হলেও আমার নানার বাড়ির দক্ষিন পাশে দীঘিটা নিজ চোখে দেখা হলেও  মা এবং মামার মুখে শুনা কথা। 

সে উড়ো দীঘির চারিপাশের পাড় নাকি পাহাড়ের মত উঁচো উঁচো ছিল।জঙ্গলও বড় বড় গাছালিতে ভরা ছিল। সেখানে নাকি বাঘ হরিনও থাকতো। উড়ো  দীঘির পশ্চিম পাশে একটা বাঘবাড়ি আছে। একবার নাকি বিশাল একটা বাঘ এসে ঐ বাড়িতে ডুকে লঙ্কাকান্ড ঘটিয়ে দিয়েছে।বাড়ির পোষা কুকুর বিড়াল মেরে খেয়েছে, পরে হাতি নিয়ে মাউত এসে নাকি বাঘটাকে তাড়িয়েছে। সেই থেকে ঐ বাড়িটার নাম হয়ে গেল বাঘবাড়ি।

নোরার বাবা  নুর ফরিন শীপে চাকুরি করতেন। তিনি বিদেশ থেকে মোটা মোটা জাহাজের নোঙর বাঁধা রশি এনে রেখেছেন ঘরে। সেই রশি দিয়ে প্রতিরাত নোরাকে বেঁধে রাখা হতো নির্জন কক্ষে।কিন্তু নীশি রাতে সেই মোটা রশির বাঁধন খুলে তার বাবার বিদেশ থেকে আনা নাম খচিত কাশের বদনা নিয়ে বাহির হয়ে যেত। সকাল বেলায় দুর দুরান্ত কোন নির্জন বাগান কিংবা কোন এলাকা থেকে নোরাকে খুজে ধরে আনা হতো।দেখা যেত সে মনের আনন্দে গান করছে। আর সবাই কহা বলা করতো, কোন জ্বীন কিংবা পরি এসে তার বাঁধন খুলে তাকে নিয়ে গেছে।এমন মোটা শক্ত রশি কোন ভাবেই নোরার পক্ষে খোলা সম্ভব নয়।কিন্তু খুললো কি ভাবে, সকালে সবাই অবাক হতো! 

ধরে আনার সময়  নিঃষ্পাপ নোরার মুখে তখনো সুরেলা কন্ঠে গান শুনা যেত, নাচের বান করতো।আবল তাবল বকলেও তাতে ছিল বিকশিত দুরদর্শি জ্ঞান প্রজ্ঞা।পাগলের প্রলাপ ছিল না কোন মতে।

নোরাকে নিয়ে নোরার মা বাবা পড়লো ভীষন বিপদে।চাকুরিজীবি স্বামী তো তাকে এমন অবস্হায় বাপের বাড়ি রেখে চলে গেলেন কর্ম ক্ষেত্রে।মেয়েরা অবশ্যই মা-বাবার কাছে ভোজা নয়।বড় ভোজা হলো নোরার পাগলপনা।

এ যুগের মেয়েরা অবশ্যই মা-বাবার উপর ভয়ানক ভোজা হয়ে আবির্ভাব হয়। প্রথমে মা বাবাকে না জানিয়ে টাকা পয়সা গয়না পাতি নিয়ে কোন বখাটের হাত ধরে ভাগে। পরে দু চারটা ইয়াজুজ মিয়াজুজ সাথে নিয়ে কখনও বা বেকার স্বামীকে নিয়ে বিরাট ভোজা হয়ে বাবার কাঁধে চেপে বসে।অনেক মেয়ে আবার বিয়ের আগেই পেট লাগায়ে কুলের মুখে কালি মাখে।তাদেরকে নাকি বলে কুলাঙ্গার।

নোরা মেয়েটির নামে কোন গিবত বা তেমন কোন দুর্নাম শুনা যায়নি, তবে কোন এক মাস্টার নাকি নোরাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল।নোরার বাবা মা রাজি হয়নি ছেলে গরিব বিদায়।হয়তো বা সে মাস্টার তাবিজ তুমার করে নোরার খতি করতে পারে।  নোরার মা ছিলেন মফস্বলের গুনবতি সুশিক্ষিত পর্দানশীল বুজর্গ একজন মহিশী নারী।তিনি বাংলা আরবি লেখাপড়া জানতেন।নোরাকেও তিনি লেখা পড়া শিখিয়েছেন নিজ দায়িত্বে।শুধু প্রচলিত বা প্রথাগত শিক্ষা নয়, তিনি নোরাকে ন্যায় নৈতিকতা শিখিয়েছেন। আজকালকার মেয়েদের কথা আলাদা।

নোরার পাগলপনা জানাজানি হয়ে গেল দুরবর্তি দশ গ্রামে।নোরার বাবার বাড়ির সামনে দিয়ে সরকারি রাস্তা দিয়ে লোকজন শহরের দিকে যায় আসে।সবাই খানিক দাঁড়ায়ে নোরার তামাসা দেখে।কহাবলা করে আয় হায় রে, অমুকের মেয়েটা পাগল হয়ে গেল। অনেকে নোরার বাবাকে ডেকে পরামর্শ দেন অমুক জায়গায় ভালো একটা খোনার আছে, তমুক জায়গায় ভালো একটা কবিরাজ আছে।আপনার মেয়েকে ভালো করে দিবে। ইনশাআল্লাহ ! আপনার মেয়ে ভালো হয়ে যাবে।চিন্তা করেন না, ইত্যাদি।

বিদেশ ফেরত মোটাসোটা সন্মানি ব্যক্তি  নোরার বাবা যে যেমনি বলতো, তেমনি শুনতেন।মেয়ের জন্য  টাকা পয়সা খরচ করতে কার্পন্য করতেন না। হন্যে হয়ে ছুটে যেতেন খোনার খলিফা কবিরাজের কাছে। নিয়ে আসতেন বাড়ি।কেউ বলতো জ্বিনে ধরছে, সুতরাং জ্বীনের হাজিরা মিলাতে হবে।কেউ বলছে পরীতে ধরেছে, পরী তাড়াতে হবে। কেউ বলছে, আপনাদের কেউ ভালো চায় না তাই কেউ দুষমনি করে ভোঁজ পাতায় তাবিজ করেছে, তাবিজ নষ্ট করতে হবে।নোয়াখালির প্রত্যান্ত অঞ্চলে এমন কোন খোনার খলিফা কবিরাজ বাদ ছিলনা, নোরার বাবা যে আনেনি।টিবরা মগা চাকমা এমন কি ভারতের ভেনারসের কবিরাজ ও আনা হয়েছে নোরার জন্যে।কিছুতেই নোরা ভালো হচ্ছে না। 

অসহায় নোরার বাবা যে বাবার ভবতা দিয়ে নোরাকে এত ভালোবাসতেন, তা পৃথিবীর সকল বাবার জন্য অনুকরনিয় ও বাস্তব দৃষ্টান্ত। আজ ভাবছি মেয়েরা  বাবার ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে স্বামীর বাড়িতে যাবার কারণেই বুঝি এত কাঁদে। 

খোনার খলিফা ঝাঁড়ফুক তাবিজ তুমার বানর টিয়া পাখির গননা,হাত দেখা কবিরাজি যে বাংলাদেশে বিরাট এক ভন্ডামি ও প্রতারনা সেটা আমি শিশুকাল থেকেই দেখে এসছি।বড় হয়ে এসব ভন্ড প্রতারককে আমি নিজ হাতে মেরেছি। সেটাও বলবো আগে। শুনে অবশ্যই মজা পাবেন।

প্রায় দুবছর চললো এভাবে নোরার পাগলপনা।কিছুতেই নোরা ভালো হচ্ছেনা।জানাশুনা নোয়াখালির এমন কোন খোনার খলিফা নোরাকে ভালো করতে পারলোনা।নোরার স্বামী শাহ আলম ও এসে আদর যত্ন ভালোবাসা দিয়ে চেষ্টা করেছে কিছুতেই নোরা ভালো হচ্ছে না।  নোরার মা প্রবিত্র কোরআনের আয়াত দিয়ে দোয়া গাঞ্জল আরশ পড়ে ঝাড়ফুক দিয়ে চেষ্টা করেছে কিছুতেই নোরা ভালো হলোনা।

 নোরাও দিন দিন ভীষন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।  একদিন নোরাকে গা গোছল করায়ে তার মা তার লম্বা লম্বা চুলে নাড়িকেল তেল মেকে বেলি কেটে দিচ্ছিল।সে সময় বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে কাপড়ের থলি কাঁধে করে বয়োষ্কো একজন লোক যাচ্ছিলেন। হটাৎ দৃষ্টি গোছর হতেই নোরা দৌড়ে গিয়ে লোকটিকে ঝাঁপটে ধরে বললো, তুমি আমার বাবা। তুমিই আমাকে ভালো করতে পারবে।আমাকে ভালো করে দাও বাবা।আমি আর পারছিনা। সবকিছু অসহ্য লাগছে।

একেবারে লোকটিকে ধরে আমাদের কাছারি ঘরে নিয়ে এলো।অনেক মানুষ জড়ো হয়ে লোকটিকে গিরে ধরে দাঁড়ালো।আগুন্তক লোকটি বুজর্গ লোকের মত কাছারি ঘরে একটা হাতাওলা চ্যায়ারে বসে শান্তশিস্ট ভাবে  মৃদু হেসে বললো, হ হ বেটি আমি তোর বাবা, আমি তোকে ভালো করতে এসেছি। আল্লাহর রহমতে তুই ভালো হয়ে যাবি।ভাবিস না তুই।

লোকটির অবয়ব যে এখনো আমার হৃদয়পটে ভাসছে। বয়স সত্তরের কম হবেনা।চুল দাঁড়ি সব সফেত, গলায় দু রঙের দুটা তসবি ঝুলানো।   অপরিচিত লোকটি তার থলি থেকে কিছু কিছমিস বাহির করে নোরাকে খেতে দিল। নোরা আলাথালু করে খেতে লাগলো।তারপর লোকটি পুনরায় থলি থেকে একটা সরিসার তেলের শিশি বাহির করে মুখে ঠোঁট নাড়িয়ে কি যেন বড় বড় করে পড়ে ফুঁ দিয়ে নোরার মাথায় মেখে আদর করে তার মাথায় হাত বুলায়ে দিল।

বৃদ্ধের এই সব যেন চুম্বকের মত কাজ করলো। সাথে সাথে নোরার বিহেবিতে পরিবর্তন এসে গেল।কথা বার্তায় চেহারায় মাধুর্য ফিরে এল। শুনতে আজগুবি লাগলেও এটাই বাস্তব সত্য। দশ গ্রামের খোনার খলিফা কবিরাজ তাবিজ তুমার দিয়ে যে নোরাকে ভালো করতে পারলো না।সেই নোরাকে আগুন্তক এই বুড়ো কি ভাবে নোরাকে কয়েক মুহুর্ত্যের মধ্যে এ ভাবে ভালো করে দিবে।নোরার মত একটি পাগলি মেয়ে জানলোই বা কি করে। অপরিচিত কোন পথিকের ঝুলিতে কিছমিস থাকবে, সরিসার তৈল থাকবে, তাকে ভালো করে দিতে পারবে, সেটা আজও এক বিশ্ময়!

 বেশ কিছুক্ষন পরে লোকটি যাবার সময় নোরাকে আশ্বস্ত করে বললো,  তোকে দেখতে আমি আবার আসবো।মা তুই ভালো থাকিস।আল্লা হাফেজ বলে চলে গেল।আমরা সবাই  লোকটির চলে যাবার দিকে অপলকে চেয়ে রলাম বেশ কিছুক্ষন।লোকটি কি আল্লাহর প্রেরিত কোন বান্ধা ছিলেন, ভাবছি মনে মনে।


                                                                 ( তিন)

আমি তখন সবে মাত্র স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি।

ইলেস্টিকওলা হাপফেন্ট পরি।ইংলিশ হাপপেন্ট তখনও আসেনি। মাঝেমধ্যে লুঙ্গিও পরি বাড়িতে। দিন দিন দুরন্ত হয়ে উঠছি।বাড়ির আশেপাশের গাছগাছালির ফলমুল পেড়ে খাই।শালিক ঘুঘুর ছানা নিয়ে পুষতে থাকি।ঘাঁস ফরিং এর পোঁধে দাঁড়া ডুকায়ে ছেড়ে দিয়ে আনন্দ করি। সকাল বেলায় কেউটের ভয় উপেক্ষা করে ফুল তুলি।বর্ষার দিনে কদম ফুল পাড়ি গাছে উঠে।একটা শিশুর বেড়ে উঠার প্রথম সাত বৎসর নাকি বিশেষ গুরত্বপুর্ন।যেই ঝক্কি ঝামেলার মধ্যে আমার জীবনের প্রথম সাত বছরকে আমি উপভোগ করেছি মৌমাছির মত।তা আজ এক কথায় অতুলনিয়।

দেশে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো।শুরু হলো প্রতিরোধের মুক্তি যুদ্ধ।চারিদিকে আগুনের কুন্ডলির ধোঁয়া আর বোমার বিকট শব্দে প্রকম্পিত।সবার চোখে মুখে আতঙ্ক দৃষ্যমান।যে যেদিকে পারছে গাট্টিগোট্টা গুটায়ে বাড়ির দামী জিনিস  আসবাব পত্র  ফেলে পালাচ্ছে শ্যামল বাংলার স্নিগ্ধ বৈচিত্রময় গ্রামের বাগবাগিছা কিংবা খেতের আঁকা বাঁকা শিঁতিকাটা কনিছা সরু পথ ধরে।

আমরাও মা-বাবা ভাইবোন সবার মত গণ্হব্যহীন গ্রামের দিকে ছুটতে লাগলাম।সঙ্গে চিরা মুড়ি চাল ডালের গাট্টি। সাথে তরুনি দুজন বোন শিশু মায়াসহ আমরা ভাইবোন সাত জন, মা বাবা সহ নয়জন। প্রথমে লক্ষ ছিল বানাবাড়িয়া নানার বাড়িতে গিয়ে উঠবো।নানার বাড়ি মাইজদী থেকে ছয়সাত কিলো মিটার দুর হবে, তাই অনিরাপদ ভেবে মা-বাবা দুজনে সিদ্ধান্ত নিলেন, না- নানার বাড়িতে থাকা যাবেনা। সবাইকে নিয়ে যাওয়া হবে আলাদি নগর ্ছোট খালার বাড়িতে।

রাজগঞ্জ বাজারের উত্তরে মাইজদী থেকে প্রায় দশ বার কিঃমিঃ দুর হবে আলাদি নগর।চষা খেতের সুকনো ছাকা ভেঙে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মা-বাবা আমাদেরকে নিয়ে তপুরা খালার বাড়িতে উঠলেন।আসার পথে মা বারবার বলছেন।আমার দেলু নুরির কি হবে।হে আল্লাহ তুমি তাদেরকে হেফাজত করো।

বাবা আশ্বস্ত করে বললেন, অত চিন্তা করোনা। ওদের কিছুই হবেনা, আল্লাহ ভরসা।নোরার বড় বোনের নাম দেলাপরোজ ওরফে দেলু। 

তিন চাল টিনের এক চাল খড়ের তফুরা খালার ঘর।সামানে ছনের একটি পাক ঘর। পাক ঘরের সামনে মাঝারি ধরনের একটা  বড়ই গাছ। বড় ঘরের কোনে একটি খেজুর গাছে মাটির হাঁড়ি ঝুলছে। একটা বুলবুলি ও একটি দোয়েল রস খাবার জন্য ঠেলাঠেলি করছে।পুরো বাড়িটা দেখতে আঁকা কোন ছবির মত সুন্দর।  বড়ই গাছের নীচে খালা একটি শীতল পাটি বিছায়ে আমাদেরকে বসতে দিলেন।আমরা ছোটরা জড়ো হয়ে বসলাম।

বাড়ির ছোট বড় অনেক লোক এসে আমাদেরকে ঘিরে দাঁড়ালো।সবাই শহরের খবর জানতে চায়। মা সবাইকে তীক্ষ মেঝাজে বললো, তোমরা এখন যাওতো।আমার সন্তানরা সারাদিন না খেয়ে আছে, তোমরা কেমন লোক খবর জানতেে এসেছ? আগে এদেরকে খেতে দাও।পরে তফুরা খালাকে বললো,  তফুরা এখানে চিরা মুড়ি গুড় আছে, জলদি এদেরকে পানিকাঞ্জি খেতে দে । এখানে চাউল আছে জলদি ভাত বসায়ে দে।ওরা সারাদিন না খেয়ে আছে।মায়ের মমতার ব্যকুলতা দেখে সেদিন অনূভব করতে না পারলেও আজ আমি অনুভব করছি দুচোখের মোটা মোটা জলে।

আমার মা এমনই ছিলেন সবাইকে শাসন করার এবং মুহুর্ত্যেই আপন করে নেওয়ার মোহময় শক্তি তার মধ্যে ছিল।সে কারণে আত্মীয় স্বজন মাকে ভীষন ভয়ও পেত,আবার সন্মানও করতো।

ঝড় বৃষ্টি কিংবা হিংস্রোদের কবল থেকে মা যেমনি তার সন্তানদেরকে ডানার নীচে লুকায়, আমার মাও সব সময় কাঙ্গারুর বাচ্ছার মত সদা আমাদেরকেও আপদে বিপদে আঁচল তলে লুকাতেন। আমার সেই করুণাময়ি মা ছিলেন ভালোবাসার এক দোওয়ার দরিয়া।

আমরা মা এর ঘা ঘেঁসে বসে  চিড়া মুড়ি খাচ্ছি।ফুটফুটে সুন্দরী খালাতো বোন একটি পাকা নিয়ে আমাদেরকে বাতাস করছে।আমি বার বার সুকনো মুখে তৃষ্ণার্থ চোখে  অপলকে সেই খালাতো বোনটির দিকে চেয়ে রলাম।ইস! এত সুন্দর কি মানুষ হয়। মেয়ে মানুষ!ইস! আমিও যদি তার সমান বড় হতাম! মনে মনে তার সাথে কদ মিলায়ে দেখি। না লম্বা এবং বয়সে আমার অনেক বড় সেই বোনটি। আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র।

তফুরা খালা ছিলেন শ্যামলা ছিপছিপে লম্বা।খালু ছিলেন বেশ সুন্দর খাটো শান্ত স্বভাবের।আর আমাদের  মা ছিলেন ছিপছিপে উজ্জল সন্দুর,  বাবাও স্বাস্হবান বেশ সুন্দর ছিলেন।দেখতে ওরিয়েন্ট এলাকার লোক মনে হতো।

খালা একটা বলে করে চিড়া মুড়ি মিশায়ে ঘুড় দিয়ে এনে দিল। খালু নিজে গাছে উঠে ডাব কেটে বাবাকে খেতে দিল। মাটির কলস ভর্তি পানি দিল।ভাতের পানি বসায়ে দিল মাটির চুলোয়।আমরা সুকনো মুড়ি খাচ্ছি, পর পর কলস থেকে পানি ডেলে খাচ্ছি।

ছোট খালার ঘরের সামনে ছোট জায়গা জুড়ে মাইরা বা ডাঁটা লাগানো হয়েছে। লাল সাদা রঙের মাইরাগুলি সতেজ হয়ে দাঁড়িয়ে পত পত করে দুলছে মৃদু বাতাসে।এখুনি খাবার উপযুক্ত সময়।

মা খালাকে বললো, দেখ তাড়াতাড়ি বাদশাকে ভাত দে।দেখ ওর মুখ কেমন শুকায়ে আসছে।

খালা উঠোনের আঙিনা থেকে মাইরা বেশ কয়টা উঠায়ে, কেটেকুটে সুটকি দিয়ে তরকারি পাকাতে লাগলো।তরকারির গন্ধ্যে মোহময় হয়ে গেল চারিদিক। মুখে টস টস করে পানি এসে গেল।

বাবা আর বড় ভাই উঠোনের অন্য প্রান্তে চ্যায়ারে বসে সবাইকে শহরের খবর জানাচ্ছে।সবার চোখে মুখে আতঙ্কের রেখা ফুটে উঠেছে।শুধু আমার বাবাকে দেখেছি স্বপ্নীল আশাবাদি।

এই দুঃসময়ে নোরা কোথায়, কেউ জানেনা।নোরার বড় বোন দেলু থাকেন দিনাজপুরের পঞ্চগড়ে।দেলুর বর তহশীলদারের নকরি করেন।আর নোরার স্বামী আলম পুলিশে চাকুরি করেন, তাও পোস্টিং ঢাকাতে।পাক হায়েনারা প্রথমে সুপরিকল্পিত গনহত্যা অপারেশন সার্সলাইট প্রথমে নাকি ঢাকা রাজার বাগে পুলিশ ফাঁড়িতেই  শুরু করে।হাজারে হাজারে পুলিশকে নাকি এক রাতেই হত্যা করা হয়েছে। এ সবি রেডিওর খবর।আমরা বাড়িতে থাকতে শফিক চাচার রেডিওতে শুনেছিলাম।না জানি নোরার স্বামি শাহ আলমের কি হলো?

অবশ্য ভরসাস্হল ছিল একটা। নোরার চাচতো দেবর মানিক হাজি ওরফে কবির উল্যা ছিলেন রাজাকারের লিডার। যুদ্ধের সময় বাড়িতে কিংবা আশে পাশে এক দুজন রাজাকারের দরকার ছিল।যেমন আমাদের পড়শি ছিলেন জয়নাল রাজাকার।জয়নাল আমাদের বাড়িতে এসে সবাইকে আশ্বস্হ করলেন এই বলে. যে আমি বেঁচে থাকতে আপনাদের কিছুই হবেনা।সেই উঠতি বয়সি তরুন লিডার মানিক হাজি মজিদ হাজি বাড়ির  সবাইকে যুদ্ধের নয় মাস হেফাজত করেছেন।সে বাড়িতে এমন কোন মৃর্ত্যুর সংবাদ আমরা পাইনি।

মানিক হাজি ছিলেন খুবি সুচতুর লিডার। পরবর্তিতে দেশ স্বাধীন হলে সব রাজাকারকে হত্যা করা হলেও মানিক হাজি সুকৌশলে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সারোয়ার সাহেবের একমাত্র বোনকে বিয়ে করে অলৌকিক ভাবে বেঁচে গেছেন। আজো বেঁচে আছেন। আমি তার লম্বা হায়াত ও সুস্বাস্হ কামনা করি। 

                                                               (চার,)

নোরা ছিল আমার মেঝ বোন।

এই পৃথিবীতে কিছু সম্পর্ক হয় আল্লাহ প্রেরিত, আর কিছু সম্পর্ক মানুষ গড়ে নেয় প্রেম প্রিতী ভালোবাসার মাধ্যমে।এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে দেখা যায় অনেক সময় ঐশ্বরিক রক্তের সম্পর্কের চেয়েও হৃদয়ের সম্পর্ক বড় হয়ে উঠে।ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। ভাই এবং বোন এই দুটি শব্দ আমার কাছে ঘৃনা করার মত দুটি শব্দ।বন্ধু বান্ধব কেউ যদি আমাকে কোন সময় ভাই সন্বোধন করে ডাকতো, সাথে সাথে আমি সুধরায়ে দিয়ে বলতাম প্লিজ তোমরা আর কোন সময় আমাকে ভাই নামে ডেকো না।এই ভাই নামের প্রতি আমার চরম ঘৃনা।শুনে বন্ধুরা অবাক হতো।

এই ঘৃনাবোধ জন্মেছে সেদিন থেকে, যেদিন মন্টু নামে আমার এক কুলাঙ্গার ভাই আমার চৌদ্ধ হাজার ডলার মেরে দিয়েছে।সেটা বিরানব্বই সালের কথা।সেই সময় আমার টাকা দিয়ে সে নিজের নামে মাইজদী টাউনে দোকান কিনেছে। অতচ সে আমার টাকা গুলি সংসারে খরচ করেছে বলে আমাকে বুঝ দেয়। আমি মানতে পারিনি তার এমন বেঈমানি। সে সময় মাইজদীতে দুটা বাড়ি কেনা যেত  চৌদ্দ হাজার ডলার দিয়ে।ঐ টাকা নিয়ে মিন্টুর সাথে আমার চরম বিরোধ হয়। সে দিন থেকে  গত পোঁছিশ বছর ধরে আমি তার সাথে কথা বলি না।

আমার পাওনা টাকা ও সংসারের ব্যপার নিয়ে মিন্টু ও তার জার্মানী স্ত্রী গাব্রিলা মিলে একদিন আমাকে তার ঘরে আটকিয়ে মেরে আমার ডান চোখটা নষ্ট করে দিয়েছে।তার জার্মানী স্ত্রি আমাকে পুলিশের ভয় দেখায় জেলে দিবে বলে।   দেশে নাকি তার স্ত্রিকে সবাই ধর্ষন করে।

এদিকে   যুদ্ধ শেষ হলে আমরা নোরাকে  খুঁজতে একদিন তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম।

 মা এর সাথে আমি দিদার এবং মায়া  ছিল।নোরার বাড়িতে গিয়ে আমরাতো বিশ্মিত, আনন্দে আত্মভোলা।নোরার কোল জুড়ে এলো প্রথম পুত্র সন্তান।কি সুন্দর ফুটফুটে তুলতুলে চেহারা।এ যেন জ্যান্ত পুতুল।আহা! সে জাহাঙ্গির আজ মধ্য বয়সি।কেমন ভোলাভালা মানুষ।কাছ থেকে দেখি তারে দুর থেকে দেখি, মায়া হয়।কত টাকা পয়সা কত জায়গায় খরছ করেছি, কত যাকাত দান খয়রাত দিয়েছি, এতই ছোট মনের মানুষ আমি কোনদিন পারিনি তার হাতে দশটা টাকা দিতে, অথবা একটা লুঙ্গি কিনে দিতে।নিজকে বড়ই অপরাধি মনে হয়।আসলে তারা সবাই ভাই বোন  একটু উচ্চ আকাঙ্খি ও অভিমানি।তারা বড়দের বা মায়মুরুব্বির কথা রাখতে জানেনা।হয়তো বা অনাথ বিদায় শিখেনি।

 সবার চোখে মুখে আনন্দের পোয়ারা।নোরা ও তার বর স্বাশুড়ি সবার চোখে মুখে আনন্দ ঝলঝল করছে।আমাদের কি কম আনন্দ।এই প্রথম কোন ভাগিনাকে দেখছি। আহা কি সুন্দর শিশুটি সদ্য স্বাধীন দেশের নাগরিক হলো। নিশ্চয় বড় হয়ে অনিয়ন্ত্রিত স্বপ্ন দেখবে।ানেক বড় মানুষ হবে।

নুর গ্রহ অর্থ্যাৎ নুরের পৃথিবী।নোরার স্বামীর নাম শাহ আলম, তার অর্থও হলো কবি বা মহৎ ব্যক্তির পৃথিবী।মা বাবার সাথে মিল রেখে নোরারা স্বামি স্ত্রি মিলে প্রথম সন্তানের নাম রাখলো জাহাঙ্গির আলম।তার অর্থও হলো বিজেতার পৃথিবী। পরবর্তিতে নোরার আরো চার ছেলে দুই মেয়ে জন্ম নিল। সবার নামও আমাদের এই সুন্দরতম পৃথিবীর সাথে মিল রেখে রাখা হয়েছে। কি অদ্ভূত মিলন মেলা।কি অসাধরণ দুরদর্শি পরিকল্পনা। 

 যাই হউক আল্লাহর দরবারে লাখ লাখ শোকর। নোরাদের কোন ক্ষয় খতি হয়নি।স্বামি শুদ্ধ নিরাপদে তারা নাকি বাড়িতেই ছিল।জানমাল মান ইজ্জত সবি আল্লাহ হেফাজত করেছেন।পাকিস্তানি বর্বরেরা কত খুন খারাবি ধর্ষন করেছে। মানুষের ধানের গোলায় আগুন দিয়েছে।

নোরার স্বাশুড়ি সারাক্ষন শিশু জাহাঙ্গীরকে পাঁয়ের উপর শোয়ায়ে ডুলাতেন আর গুন গুন করে গান গাইতেন। মায়ের খুবি ইর্ষা হতো।আদরের নাতিকে একবার আদর করতে দিতেছেনা পাগলি বুড়িটা।আমিও ভাগিনাকে একটু আদর করতে পারছিনা।মাও তো রেগে গিয়ে নোরার স্বামিকে বলে দিল। তোমার মা দেখবা এই ছেলেটাকে এভাবে পাগল করে ছাড়বে একদিন। অত কুয়ারা করা ভালোনা। ইত্যাদি।

শিশু জাহাঙ্গির তো শুধু জ্যা জ্যা করে হাসঁছে কেবল।ডোল পড়া মুখ, কপোলের বাম পাশে মোকদোষ না লাগার কালো টিকা।অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে।

নোরার স্বামি শাহ আলম তার মাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন।তার বাবা মাকে ছেড়ে চলে গেলেও সাহআলম মাকে ছেড়ে কোথাও যাননি, দুরেও  ফেলে দেননি।মা ছেলের নাড়ির বন্দনও ভালোবাসার এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত।

নোরার বাড়িতে মায়ের সাথে আমি যতবারই গিয়েছি, আমরা বেশির ভাগ সময় কাটাতাম মা এর মামাতো বোন মজিদ হাজির স্ত্রি মানিক হাজি ও হামিদ উল্যা উকিলদের ঘরে। অনেক সময় আমরা খাওয়া দাওয়াও করতাম মানিক হাজিদের ঘরে। মজিদ হাজির পালক পুত্র ওজিউল্যা মাকে কি অসম্ভব সন্মান করতেন।সব সময় খালাম্মা খালাম্মা বলে ডাকতেন।খানাপিনা করছে কিনা মায়ের খোঁজ খবর নিতেন। ‍ওজিউল্যার ছেলে পলাশ ও ঠিক বাবার মত ছিলেন অমায়িক।নোয়াখালি কলেজে ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েও সে ছিল সাধারণ ছাত্রের মত।সদালাপি মৃদু ভাষি ভদ্র নম্র পলাশকে আমি সব সময় মিস করি। মন চায় বসে বসে দীর্ঘক্ষন তার সাথে আলাপ করি।

মায়ের সাথে যতবার আমি গিয়েছি, ততবারই মানিক হাজির ভয়ে তটস্হ থাকতাম। সুটাম দেহের অধিকারি মানিক হাজি প্রতি প্রাতে ঘোড়ার মত কাঁচা বুট খেতেন।ব্যায়াম করে পেশি শক্তি বাড়াতেন। ভাত খেতেন হাতের তালুতে প্লেট রেখে হেঁটে হেঁটে।সে এক স্মার্টনেস স্টাইল। কিন্তু সে আমাকে দেখলেই দৌড়াতেন এই বলে, তোর নুনু কেটে দেব।এই দাঁড়া চুরি কইরে চুরি লও এর নুনু কাটবো। ভয়ে এবং লজ্জায় আমার কলিজা ধুক ধুক করতো।পরে দেখলাম মানিক হাজি আমাকে কোলে তুলে আদর করতো মুখে চুমো দিয়ে আদর করে চেড়ে দিত।নুনু আর কাটতো না।

আমি যখন ভয়ে দৌড়ায়ে মায়ের অথবা বোনের আঁ্রল তলে লুকাতাম। নোরা এবং মা তখন হাঁসতে হাঁসতে বলতেন।আরে আরে তোর ভাইয়া না  কিছুই করবেনা। নোরার স্বামী সাহ আলমও  অনেক সময় আমাকে ভয় দেখাতো এই বলে যে মানিক আসছে মানিক আসছে।আর খিল খিল করে হাঁসতোে আবার সিগারেট টেনে খ্যাঁক খ্যাঁক করে কাশতো।

সোনা সোহাগায় ভরা ছিল নোরার সোনার সংসার।স্বামী সন্তান স্বাশুড়িকে নিয়ে ছিল তার সুখি পরিবার। লাল টালি ইটের চারছালা ছোট একটা ঘর। ভিতরে পার্টিসান।বড় বড় দুটা খাট পাতা।পাকসাক হতো এক চালা এটাস্ট একটা ঘরে।

  ঘরের পিছনে ঢেলার সাথেই ছিল বড় বড় তিনটা কাঁঠাল গাছ। তার পিছনে বিশাল বড় একটা তেতুল গাছ ।তারও পিছনে আড়ায় ্ছিল বিশাল একটা জলপাই গাছ। সারি সারি গুবাক গাব আম গাছে ভরা ছিল তাদের ঘরের পিছনে বিশাল বাগানটা । আবার মানিক হাজিদের ঘরের পিছনের বিশাল বাগানটা ছিল মানিক হাজিদের।গুবাক নারিকেল আমঝাম গাছে ভরা ছিলো পুরোটা বাগান জুড়ে। সে বাগানে দিনে ডুকলেও গা টা হিম শিম হয়ে উঠতো ভয়ে।ধুক ধুক করতো বুকটা।

বাগান ছাড়াও নোরাদের ্র প্রচুর ভিটে জমিন ও ধানি জমিন ছিল।তাদের বাড়ির সামনে বড়ো পুকুরের উত্তর পাড়ে ছিল ভিটে জমিন। সেখানে ফসখেতি হতো।দু পাশে আম ঝাম কাজম এবং কাউ গাছ ছিল। কাউ ফল গোল গোল খেতে তেতুলের মত টকমিস্টি। পেকে হলুদ লালে মিশ্রিত আকার ধারণ করতো।সে বাড়ির  ছিদ্দিক মিঞার দু মেয়ে ছিল আমার সম বয়সি।দুটাই ছটপটে দুরন্ত প্রকৃতির।মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শফি মিঞার আপন ভাগনি হলেও মেয়ে দুটির বাবা দিন মুজুরের কাজ করতেন। বাবা দেখতে কুছকুচে কালো হলেও মেয়ে দুটি ছিল অসম্ভব সুন্দরী। মেয়ে দুটি আমার সাথে লক লকিয়ে গাছে উঠে যেত।বানরের মত সরু ঠালেও চটপট করতে পারতো।তাদের নাম এখন আর আমার মনে পড়ছেনা মেনু মনি টাইপের কিছু হবে আর কি।

দেখতে দুজনকেই জমজ বোনের মত মনে হতো। হয়তো গোলাপ নয় শিউলি চ্যামেলির মত সুন্দর।দুজনেই হাফপ্যন্টের সাথে বড় চ্যাকের ফ্রগ পড়তো।আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা কাউ তেতুল কিংবা জলফাই গাছের মগ ডালে বসে কাটিয়ে দিতেম।কখনো  ওরা এক বোন থাকতো কখনো বা দুজনই একসাথে থাকতো।দুজনই আমাকে বেশ পছন্দ করতো। আমরাও ফুরসত পেলেই  গিয়ে গাছের মগ ডালে উঠে বসতাম।ফল খাওয়ার সাথে সাথে আলাপ চলতো অবিরত।সেই ছিল এক অনুপম অভিসার।

আমরা তখন তিন কিশোর কিশোরি আকির্ন করেছিলাম এক নতুন মাধুর্যময় পৃথিবী। কিন্তু ভালোবাসা বা প্রেম ছিলনা হয়তো, আকর্ষন ছিল চুম্বকের। বাধ সাধতো তাদের এক কাকা ছিল সে হটাৎ করে এসে আমাদেরকে ধরে ডাঁটতো বা বকা ছকা করে থাপ্পর চড় বসিয়ে দিত।তাদের বাবা কালো হলেও সেই কাকা ভীষন সুন্দর ছিল।মেয়ে দুটিও ছিল যেন   অবিকল তার পয়দাসে।চেহারাসুরত অবিকল চাচার মত।পরে কানাঘুষা শুনেছি, ভাবির সাথে নাকি তার অনৈতিক সম্পর্ক ছিল।

মেয়ে দুটিকে আমার অসম্ভব ভালো লাগতো।তারাও আমাকে ভীষন পছন্দ করতো নিশ্চয়। তা না হলে একটু ফাঁক পেলেই কেন আমরা ইশারায় আশারায় চোখের ভাষায়  এত কথা বলতাম।কেন লোকরণ্যে গিয়ে অভিসার সাজাতাম?কেন ফলন্ত গাছের মগ ডালে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতাম?কেন ভাগাভাগি করে ফল মুল পেড়ে খেতাম?

একদিন হঠাৎ করে নোরাদের বাড়ি যাওয়া আমার চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।  কেন সে কাহিনীও বলবো আগে। আমার শৈশবের প্রেম,রোমাঞ্চকর পৃথিবী পম্পে নগরির মত নিমীশেই যেন নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেল।স্বপ্নাবতি মেয়ে দুটির ছবি আজো ভেসে উঠে হৃদয় পটে।জানিনা আজ তারা কে কোথায় কেমন আছে?

 যাই হউক ভিটে জমিনের পাশেই  পশ্চিম উত্তরে নোরাদের বেশ বড় বড় নাল জমিন ছিল। সেই জমিনে বর্গা চাষীরা চাষ করতো, প্রচুর ধান ফলতো।বাড়ির পশ্চিম দক্ষিন কোনে বিরাট একটা অগভীর দীঘি ছিল।সেখানেও প্রচুর ইরি ধান ফলতো।লোক মুখে শুনতাম এই মাইজদী বাজারের মাছ বাজার আর ফরেস্ট বিভাগ সহ প্রায়  অর্ধ্যেক জায়গা  নাকি তাদের ছিল।

এত ধন সম্পদ জায়গা জমিন থাকতেও নোরার সংসার ভেঙে চুরমার হয়ে গেল কেমন করে।কেন নোরা ত্রিশ বছর ধরে আজো লাফাত্তা নিরুদ্দেশ? কোথায় আজ নোরা? কেন  নোরার সন্তানরা আজো দ্বারে দ্বারে ধিক্ষীত এবং উপেক্ষিত?কোথায় নোরার প্রাণপ্রিয় পতি শাহ্ আলম? সে এক করুন ট্রেজেডি!না শুনলে আমরা জানবো কি করে? 

                                                       (পাঁচ,)
দেশ স্বাধীন হলো কিন্তু ধ্বংশস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে আছে দেশ ।

চারিদিকে অভাব অনটন দুর্ভীক্ষ।যুদ্ধাগ্রস্হ একটা দেশের যেই দৈন্য দশা ঠিক সেই রকম অবস্হা সদ্য জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও।মুক্তি যোদ্ধারা তখনও অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে গুরে বেড়ায় মোহরা দেয়। মাইজদী বাজারের শফি কমান্ডার সারোয়ার সাহেবরা দলবল নিয়ে কাঁদে ভারি অস্ত্র ঝুলায়ে রাজাকার খুজে খুজে মারে। কাউকে ব্রাস ফায়ার করে জানে মারে কাউকে আবার আধামারা করে চেড়ে দেয়। একলাশ পুরের খালেক তো কালাম কাগুর বন্ধু হিসেবে স্টেন গান নিয়ে প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতো. রাত ভরা অস্ত্রের মোহরা দিত ,বাড়ির কয়েকজন তরুনকে শিখাতো বন্দুকবাজি।


নোরার বাবা ইতিমধ্যে বেশ কয়বার চিটাগাং যেয়ে এসে বাংলাদেশি  একটা জাহাজের  নলি বানিয়ে জাপানি একটা শীপের সাথে শৈন চুক্তি করে জাহাজের নোঙরও তুললেন।এ নিয়ে তাঁর  ব্রিটিশ পাকিস্তান বাংলাদেশ সহ তিন প্রিরিয়ডের নলি হলো।তার জীবনের নোঙ্গর ফেলেছেন পৃথিবীর বিখ্যাত বিখ্যাত সব বন্দরে।
 আমি তো মা এর সাথে বেশ কয়বার নোরার বাড়িতে যেয়ে এসে রাস্তাঘাট জেনে নিলাম। মাঝে মধ্যে মা পিঠা চিড়া মুড়ি ভেজে আমাকে বলতো , যা তোর আপাকে দিয়ে আয়।আমি তো যাওয়ার জন্য খুশিতে উচ্ছসিত হতাম।সে বাড়িতে দুটা ফুটফুটে মেয়ের সাথে তো ইতিমধ্যে  আমার সখ্যতা হয়ে গেছে।গেলেই তো আমরা ফলন্ত গাছে চড়ে বাতাসের গায়ে দোল খেতে পারবো।  
নোরাদের বাড়িতে দু তিনদিক দিয়েই যাওয়া যেত।আমি বেশির ভাগ বর্তমান আলআমিন বিস্কুট ফেক্টরির সামনে হয়ে বাড়ির পিছন দিয়ে ডুকতাম। আলআমিন বিস্কুট ফেক্টরির পশ্চিম পাশে একটা হিন্দু বাড়ি ছিল।বোধ হয় মাখন ডাঃদের বাড়ি। মা এর মুখে শুনতাম তারা নাকি প্রেগনেট কোন মহিলা দেখলে ধরে নিয়ে পেট কেটে পরিক্ষা নিরিক্ষা করতো।জঙ্গলে ভরা ছিল সেই এলাকা। যেতে আসতে ভয়ে বুকটা ধুক ধুক করতো।কি করবো  সেখানে গেলে তো নোরা যেমনি আমাকে অফুরন্ত আদর করে,  মেয়ে দুটিও আমকে সে রকম ভালোবাসে।তবে একটু ভয় ছিল মানিক হাজির। প্রায়ই যাই আসি, মাঝে মাঝে বেশ কয়দিন থেকে যেতাম নোরার বাড়িতে।জাহাঙ্গীরের সাথে খেলতাম, দুষ্টোমি করতাম।

জাহাঙ্গীর শব্দের অর্থ বিজেতা, জাহাঙ্গীরকে দেখতেও বিজেতা কোন ফ্রিন্সের মত মনে হতো।তাকে কোলে নিয়ে কাঁধে বসায়ে গুরতে খেলা করতে আমার গর্ববোধ হত আনন্দও পেতাম।

এক নীশি রাতে নোরা হঠাৎ করে আবার শুরু করে দিল পাগলামি।ঘরের পুর্বদিকে পার্টিশানে বড় একটা খাটে আমরা শুয়ে ছিলাম, পশ্চিম দিকের পার্টিশানে শুয়েছিল নোরাও তার স্বাশুড়ি।নোরা সেই আগের মত আবল তাবল বকতে লাগলো।আমাকে সাবধান করে বকছে ভাই তুই নীচে নামিস না তোকে ছলি নিয়ে যাবে।ছলিরা সাতটা সোনার পাতিল আমাকে সাধছে তোর বিনিময়ে।আমি সাতটা  সোনার পাতিল চাই না, আমি চাই আমার ভাইকে।আমার ভাই এর কিছু হতে আমি দিবনা।সাবধান! ভাই তুই নীচে নামিস না তোকে ওরা নিয়ে যাবে,তোকে ওরা মেরে ফেলবে। ভাই তুই আমার সাত মুল্লকের বাদশা। এই দেখ আমার ঘরের ভিতর কত বড় গর্ত হয়ে গেছে।এখান দিয়ে টাকার পাতিলা সোনার পাতিলা এসেছে।ইত্যাদি।

সে রাতে ভয়ে আতঙ্কিত আমার কলিজা হৃৎপিন্ড আর বুকে ্ছিলনা।ভোর হতেই বাড়ির লোকজন সহ মানিক হাজির মা এসে আমাকে উদ্ধার করে বাড়িতে পাঠায় মাকে নিয়ে আসার জন্য।ভয়ার্ত ভাবে আমি বাড়িতে এসে তটব্যস্ত হয়ে খবরটা মা কে শুনালাম।
 মা তো শুনে হায়! আল্লা! হা! আল্লা! রহমত কর আমার মাইয়াটারে বলে পাগলের মত  বড় ভাই খোকনকে নিয়ে নোরার বাড়িতে চলে আসলো। সাথে আমিও এলাম।নোরার তান্ডবে কান্ড কির্তীতে বাড়ির সবাই হতভম্ভ। 
 
  মা এসে ঘরটা ফরখ করে দেখলো। সত্যিই ঘরের পশ্চিম দিকের মধ্য খানে  বিরাট একটা গর্ত পিছনের দিকে চলে গেছে।আবারো খোনার খলিফাকে ডেকে পাঠালো। নোরার স্বামি শাহ আলম তখন ঢাকাতে, তাকেও খবর দেওয়া হলো। দুপুরের দিকে তিনজন মোল্লা টাইপের খোনার খলিফার এসে বাড়ির লোকজনকে নিয়ে গর্তটা পরিক্ষা নিরীক্ষা করে দেখতে লাগলো।

 কেউ বলছে হ্যাঁ হয়তো পাগলির কথাই সত্যি। এত বড় গর্ত  হবার তো কথা নয়।নিশ্চয় টাকার পাতিল এসছে। আবার কেউ বলছে বাজে কথা কাঁঠাল গাছের মোটা শিকড় ঘরে ডুকছে,সে কারণে গর্ত হয়েছে।আবার কেউ বলছে ভূত পেত্নি বা জ্বীনে ধরেছে। সুতরাং আছর কছর তাড়াতে হবে।কেউ বলছে ঘরের পিছনে এত বড় তেতুল গাছ রাখা ঠিক হয়নি।এই গাছটা কেটে ফেলতে হবে ইত্যাদি।
বাড়ির অন্যান্য লোকেরা নারী পুরুষ দল বেঁধে   কেউ ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে হাঁসছে, আবার কেউ আতঙ্ক গ্রস্হ হয়ে দাঁড়িয়ে তামাসা দেখছে।

নোরার বাড়ি আর আমাদের বাড়ির দুরত্ব ছিল মাত্র দু কিঃ মিঃ।সে সময় আমরা তো চলাফেরা করতাম কুনিছা পথ দিয়ে।যত সর্টাকার্ট যাওয়া যায় আর কি।আমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে নোরার বাড়িতে পোঁছে গেলাম।মা তো এসেই কোরআনের আয়াত পড়ে নোরাকে ঝাঁড় ফুক শুরু করে দিল।খোনার রাও তাবিজ তুমার পানি পড়া দিয়ে গেল।

পরদিন সকালে নোরার স্বামি এলো।তখন নোরার বকবকানি প্রথমে একটু বেড়ে গেলেও পরে অবশ্য ধীরে ধীরে একটু কমতে লাগলো।স্বামিই তাকে দেখবালের দায়িত্ব নিলে আমরা বাড়ি ফিরে আসি।ঘরোয়া ভাবে খোনার খলিফা কবিরাজের মাধ্যমে নোরার সিকিৎসা চলতে লাগলো।সবাই আশাবাদি ছিল নোরা জলদি ঠিক হয়ে যাবে।হয়েছিলও তাই।পুরোপুরি সুস্হ না হলেও মোটামুটি মাস ছয়েকের মথ্যেই নোরা সুস্হ ও শান্ত হয়ে উঠলো।সোরগোল বকাচকা কমে গেল।নরমাল সাধারণ মানুষের মত স্বপ্নবতি মানুষ।

যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙ্গালীরা ভারতের উপর দিয়ে বাই রোডে বাংলাদেশে আসতে শুরু করলো। অপরদিকে আসামের উদ্ভাস্তু বাঙ্গালীরাও আসতে লাগলো।

এমনাবস্হায় একদিন নোরার স্বশুর চৌধুরী মিঞা ছয় সাতটা ছেলে মেয়েসহ চব্বিশ বছর পরে আসাম থেকে  বাড়িতে ফিরে এসে হাজির হলো।নোরার স্বামী শাহ আলম প্রথমে দুযুগ পরে পিতার আগমনে ভেজায় খুশি হলেও পরে টের পেল কি হতে যাচ্ছে। সাথে কতোগুলি ভাই বোন।কিন্তু জনাব শাহ আলমের সেই খুশিটা অল্প দিনের মধ্যেই পিকে হয়ে গেল।
আসলে এই লোকটার মধ্যে তেমন কোন হিংসা বিদ্ধেষ লোভ লালসা ছিলনা।হতে পারে তিনি তেমন বিছক্ষন ছিলেন না। নিতান্তই  সাদাসিদে সাদা মনের সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন।চব্বিশ বছর ধরে পিতার কোন খবরাখবর ছিলনা। দেশে কত বড় যুদ্ধ গেল, খরা বন্যা দুর্ভিক্ষ গেল বেঁচে ছিল না মরে গেছিল তাও কেউ বলতে পারতো না।সবার ধারণা ছিল চৌধুরি মিঞা হয়তো মারাই গেছেন।

 নোরার বাবা একদিন জামাই শাহ আলমকে ডেকে বলেছিলেন, তোমার বাবা আছে না মরে গেছে কেউ জানেনা। বেঁচে থাকলেও সে আসাম চেড়ে যে  বাংলাদেশে আর আসবে না।এই ফাঁকে ভালো হবে জায়গা জমিন গুলি তোমার নামে করে নাও।আমি তোমাকে সাহয্য করবো।
শাহ আলম বললো, এত জায়গা জমিন দিয়ে আমি কি করবো ।না ওসব দু নাম্বারি কাজ আমি করতে পারবো না।হ্যে হ্যে করে হেসে উড়িয়ে দিলেন পিতা সমান স্বশুরের কথাকে। 
   
  সোনায় সোহাগায় ভরা নোরার সংসারটাও দিন দিন চরম পরিণতির দিকে ধাবিত হতে লাগলো।নোরার স্বামী নিজেদের ঘরটা পিতাকে চেড়ে দিয়ে নিজেরা খড়ের দোছালা ছাল বানিয়ে কেঁছি দিয়ে ঘর বানিয়ে উঠোনে থাকতে শুরু করলো।বেড়াঘোড়া কিছুই নাই।মাটিতে শোয় তারা সবাই। তাতেও তারা ভেজায় খুশি।
মা সহ আমরা একদিন দেখতে গেলাম নোরাকে।নোরা মোটামুটি ভালো, কিন্তু থাকা খাওয়ার ভীষন অশুবিধা হতেছে।মা এই প্রথম দেখলো নতুন বেয়াই বেয়াইনকে।তাদের চালচলন কথাবার্তা মা এর মোটেই পছন্দ হয়নি।তবু সৌজন্য বজায় রাখতে তাদের সবাইকে এক জুম্মায় আমাদের বাড়িতে দাওয়াত করলো।বাবার অবর্তমানে সব গুরু দায়িত্ব এখন মায়ের উপর।মা ই সব কিছু দেকবাল করছে সামলাচ্ছে।

 কথামত জুম্মার দিন বিকেলে নোরার স্বশুর চৌধুরী মিঞা সবাইকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হলো।নোরার পাঁচ জন ননদ তার মধ্যে তিনজন তো বিয়ের উপযুক্ত।এক দেবর তারও বেশ বয়স হয়েছে অনেকটা চাঁড়াল টাইপের।মুখে ছোট বড় দুতিনটা কাটার দাগ।মনে হলো কোন অনৈতিক কাজে ধরা পড়ে মার খেয়ে এই হাল হয়েছে।

 নোরার স্বশুর সৎস্বাশুরি স্বামী সন্তান  দু বছরের জাহাঙ্গাীরকে নিয়ে নোরাও আসলো,কিন্তু তার আপন স্বাশুরি আসলেন না। সবাইকে বাড়ির উঠোনে গোল করে চ্যায়ার মোড়া এবং জলচকি পেতে বসতে দেওয়া হলো। পোষাক আশাকে কথা বার্তায় তাদের মধ্যে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।দা বটির ব্যবহার দেখে তারা তো অবাক! তাদের ওখানে গোশত সবজি সব কিছু চুরি দিয়ে নাকি কাটা হয়।আবার সে সময় আমাদের এখানে তো চুরির ব্যবহার তো দুর্লভ ছিল। হারাম হালালের প্রশ্ন এসে যেত। 
মা নানা রকমের খাবারের আয়োজন করলো। সবাইকে উঠানেই পাটি বিছায়ে খেতে দিল। পোলাউ কোরমা পিরনি জর্দা সবকিছু সামনে পরিবেশন করা হলো।তারা হাত দিয়েই আলু থালু করে খেয়ে সন্ধ্যে বেলায়  চলে গেল।মা অবশ্য নোরা ও তার স্বামীকে থেকে যাওয়ার জন্য বললো।কিন্তু নোরার স্বামী কোন একটা ওযুহাত তুলে চলে গেল।

 মেহমানরা যাবার সময় নোরার ছোট ভাই খোকন তাদেরকে জেল খানার মোড় পর্যন্ত  আগিয়ে দিতে গেল। পিছন পিছন বাড়ির উৎসুক আরো কয়জন লোকের  সাথে আমিও গিয়েছিলাম। 

কিছুদুর যেতেই খোকনের এক সহপাটি  কানে কানে ফিস ফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কে রে ওরা? তোর কি লাগে? 
খোকন বললো,আমার তালতো বোন। ওরা  আসাম থেকে এসছে।
সহপাটি বললো, মাল ভালা, তোর লগে বড়টারে ধারুণ মানাবে।বিয়ে করে ফেল।
খোকন লজ্জা রাঙা হয়ে বললো, বাজে কথা বলিস না তো।থাপ্পর মারমু।
পরিশেষে তাদেরকে বিদায় দিয়ে আমরা বাড়িতে ফিরে এলাম।তারাও হেঁটে হেঁটে যেতে লাগলো তাদের বাড়ির দিকে।


                                                                                                                                                                                                                  ( ছয় )
পশ্চিম মাইজদী ১নং পৌর ওয়ার্ডে আমাদের বাড়ি।
সাগর কন্যা  মাইজদী শহরের উপকন্ঠ বা শহরতলী এলাকায় অবস্হিত।প্রকৃত নাম  ইসলাম হাজী বাড়ি  হলেও বর্তমানে সীল বাড়ি হিসেবেই খ্যতি পেয়েছে বাড়িটি।
তারও একটা রহস্যজনক কারণ আছে।জনৈক জমিদার ইসলাম হাজী সাহেব বত্রিশ কানি জমিনের উপর দীগির মত বড় করে বেশ কয়টা বাড়ি নির্মান করে তার পাঁচ বিবিকে নিয়ে বসবাস করতেন।তার পাঁচ বিবির মধ্যে একজনের ঘরে কোন ছেলে সন্তান ছিল না। বাঁকি চার বিবির ঘরেই জন্ম নিয়েছে অসংখ্য সন্তান।তার প্রথম ঘরের সন্তান বড় সন্তান আরিফ নামে একজন বেতন ভূগি একমাসে আসতে দেরী হলে নাপিতকে মেরে তার খুর কেচি পুকুরে পেলে দেয়।সেই নাপিতেই বলতে শুরু করে দেয় যে ওরা আমার খুরকেছি রেখে এখন তারা নিজেরাই নাপিত বা শীলগিরী করে। সে থেকেই বাড়িটি শীল বাড়ি নামে খ্যাতি লাভ করে।
সেই ১৯৬৭ইং সনে অখন্ড পাকিস্তান সরকার একোয়ার বা হুকুম দখল করে  নতুন জেল খানা পুলিশ লাইন আধুনিক সদর  হাসপাতাল নির্মীত হবার পর বেশ আমুল পরিবর্তন হয়ে গেল আমাদের এলাকাটি । সারি সারি পাকা ইমারত রাস্তা ঘাট দেখে মনে হয় বেশ আধুনিকের  ছোঁয়া লেগেছে।অখন্ড পাকিস্তান আমলেই এ গুলির প্রায় ৯৫ ভাগ কাজ শেষ হয়েছিল।যার কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পরই চালু করতে সম্ভব হয়েছিল। 
সে সময় আমাদের পুরান  বাড়ির প্রায় আংশিক সরকার একোয়ার করে নিয়ে যায়।বাড়ির অনেকের ঘর পড়লেও আমাদের পাক ঘরের ঢেলার পাশ দিয়েই জেল খানার সিমানা পিলার পড়েছে। বিশাল দীঘির মত দুটা পুকুরের প্রায় আংশিক ভরাট হয়ে যায়।
 বাড়ির দক্ষিন দিকে পর্যাপ্ত ছাড়া বাড়ি খাকায় তারা সে দিকে গিয়ে ঘর বেঁধেছে।ভাগ্যিস আমাদের খালি একটা ছাড়া বাড়ি ছিল।যার ধরুন আমাদের বিশাল বংশটা এখনও এক সাথে আছে। নচেত কাইল্লা বাড়ির মানুষ একশ কাইললা বাড়িতে ভিবক্ত হয়ে গিয়েছিল।টাওরান বাড়ি আর দুল্লুফিদের বাড়ির কোন খোঁজ খবর নাই।তাদের বাড়িটা পড়েছিল একেবারে জেল খানার দীঘির মধ্যখানে।
দুল্লুফির বাপের নাম ছিল বেচু।বেচু মিঞা খুবি পরিশ্রমি লোক ছিলেন। বড় গাছের গোড়া উঠাতেন।  কুড়াল দিয়ে লাকড়ি কাটতেন। আমার বাপ চাচাদের নানা ডাকতেন।আমার মাকে নানি ডাকতেন। মাঝে মধ্যে আমাদের কাজ কর্ম  করতো বেচু মিঞা।একসের চাউলের ভাত খাওয়ার জন্য সে বিখ্যাত ছিল।আমরা ছোটরা তাকে দেখলেই দল বেঁধে চেঁতাতাম। বলতাম বেচু কুকু, বেচু পোঁদে লেচা ঘু।বেচু তেমন একটা চেঁততেন না। বড়রা আমাদেরকে ধমক দিয়ে থামতো।মাটির মানুষ ছিল বেচু মিঞা।
বেচু মিঞারা আমাদের বংশের কেউ ছিল না তবে ভালোই সম্পর্ক ছিল সবার সাথে।আমি বেচু মাকেও দেখেছি। সুন্দর সন্মানি মহিলা ছিলেন।বেচু ও সুন্দর ছিলেন। তার বউটা ছিল তেলতেলে কালো করে মোটাসোটা মহিলা।দুল্লুফি ও মায়ের মত ছিল, তার একটি ভাইও ছিল সুন্দর করে।পরে শুনছি তার ভাইটা কি একটা রোগে মারা গেছে, তা মাত্র দশ বার বছর বয়সে।
দুল্লুফিদের পরিবারকে আমার ছোট চাচা তার বাড়িতে জায়গা দিয়ে পরে তার মাকে নিয়ে পাটোয়ারি চাচা যা বিতি কিচ্ছা করলেন তিনটা বউ ঘরে থাকার পরেও, তা ছিল অত্যান্ত অমানবিক।অনেক সময় বেচুকে গাছের সাথে বেঁধে মেরেমুরে তার বউকে নিয়ে রঙলিলা করতো রাতভর।চাচার আরেকটি বউছিল ঝুমা নামে, পেটে লাউট স্পিকারে সাউন্ড দিয়ে ঝুমার পাঁয়ে ঘন্টা বেঁধে সারা রাত নাচাতেন।  পরে বেচুমিঞা বজরার ও দিকে গিয়ে থাকতে শুরু করে।এখন যত সম্ভব আর বেঁচে নেই।আমি বড় হবার পরেও কুড়াল কাঁদে করে কাজের খোঁজে আমাদের বাড়িতে আসতেন।কাজকর্ম না করলেও মা ভাত খাওয়ায়ে এক দু কিলো চাল তার গামছায় বেঁধে দিতেন।  সৃতির দর্পনে আজ অনেক কিছুই ভেসে উঠছে।
ঠাওরান বাড়ির মানুষরা একটু স্বচ্ছল ও শিক্ষিত ছিলেন।একোয়ার হবার আগের বছর ঠাওরান বাড়িতে একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল। বাড়ির আড়ার পাশে বড় একটি গাছের সাথে একজন মানুষ ফাঁস দিয়ে আত্ম হত্যা করলো।আমার মা চাচি জেটিরা সবাই দল বেঁধে গেল দেখতে। আমিও মা এর পিছনে পিছনে দৌড়ে গেলাম সে বাড়িতে।গিয়ে দেখি পাক ঘরে ঢেঁকির উপর দাঁড়িয়ে মহিলারা সবাই হুড়াহুড়ি করে দেখছে। হাফ পেন্ট পরা পুলিশ আনচার এসে লোকটাকে ঘিরে রাখছে। আমরা ছোটরা কাছে গিয়ে দেখলাম, মাঝ বয়সি লোকটা বাতাসে মৃদু দুলছে।জিব্বা বাহির হয়ে আছে। নিচে একটি চ্যায়ার ও এক জোড়া সেন্ডেল পড়ে আছে।একটু পর দারোগা আসার পরে রশি কেটে তিনচার জনে মিলে ধরে রশি কেটে লাশটি নামায়ে শহরের দিকে নিয়ে গেল। পরে বড় হয়ে শুনেছি লোকটি নাকি ভাবির সাথে কুকাম করে ধরা পড়ে লজ্জা শরমে আত্মহত্যা করেছে।এখন কি আর মানুষের মধ্যে সে আগের মত লজ্জা শরম হায়া বলতে কিছু আছে?

এদিকে নোরার স্বামীর বাড়ি একোয়ারে খতিগ্রস্হ না হলেও নদী ভাঙা  মানুষের মত হঠাৎ করে উচ্ছেদ হয়ে গেল নোরার পরিবার।নোরার স্বামী নোরাকে নিয়ে ঢাকা চলে গেল। সেখানে কমলাপুর স্টেষনের আসেপাশে কোন জায়গায় নাকি বাসা ভাঁড়া নিয়েছে।সেদিকে নাকি তার স্বামির কর্মক্ষেত্র এনএসআইর অফিস। আমি চিনিনা কোন দিন যাইওনি।
নোরার ভাই খোকন সাহেব ডিগ্রি পাশ করার পরে চাকুরির খোঁজে গিয়ে তাদের বাসায় উঠে।বাড়ি থেকে চাল ডাল বস্তা ভরে নিয়ে যেত।বাবার কাছ থেকে খরছের টাকা ও ঘুষের টাকাও নিত।আমি মাথায় করে নিয়ে রিকসায়া তুলে দিতাম।  এই আজকে ওমুক ব্যাংকের মেনেজারের চাকুরি হতেছে, কাল ক্যশিয়ারের। মাবাবাসহ পরিবারের সবাই আশাবাদি ছিল। তার বড় অফিসারের চাকুরি হলে অবশ্যই পরিবারের অবস্হা আরো ভালো হয়ে যাবে।
কাজের কাজ কিছুই হলো না। তার সাথে ডিগ্রি পাশ করা বাড়ির ইব্রাহিম এরি মধ্যে বাঁদর বনে চাকুরি নিয়ে বিয়ে শাদি করে নতুন ঘরও একটা করে ফেলেছে ।একদিকে চাকুরি হলো না আরেকদিকে তার বিয়ের বয়স যেতেছে। ইতি মধ্যে তার ছোট ভাই মন্টুও বিয়ে করেেএক সন্তানের বাপও হয়েছে।।
প্রায় চার পাঁচ বছর পরে একদিন নোরারা বেড়াতে আসলো আমাদের বাড়িতে।জাহাঙ্গির তখন অনেক বড় হয়ে গেছে।বাসা বাড়ির ছেলেদের মত হাফপেন্ট পড়তো সে।নাদুস নদুস চেহারা হলেও তার সর্দি নামের রোগটা স্হায়ি ভাবে বাসা বেঁধেছে তার শরিরে। সারাক্ষন নাকের হিঙ্গেল ঝরতো। 
নোরার আরেকটি ফুটফুটে ছেলে হয়েছে। নাম রাখা হয়েছে বখতিয়ার। রাজা বাদশার নাম হলেও দেখতে সত্যিই রাজ পুত্রের মত। বখতিয়ার তখন একটু একটু হাঁটতে পারে।কোলে লয়ে তাকেও অনেক আদর করেছিলাম।তখন আমার ভাগিনা বলতে একমাত্র তারাই ছিল। 
  






                                                              (সাত)
                                                              (আট)

                                                                                      (নয়)

 (দশ)

                                                                                                                                                                                                                পড়তে থাকুন আগে....

অজ্ঞসব জনপ্রতিনীধি,

সত্যই শক্তি, সত্যই সুন্দর,