Friday, April 16, 2021

১০ই মে বাবার বিদায় বেলার দিনঃঃ---



বাবা তোমাকে আজ আমার  মনে পড়ছে,খুব করে মনে পড়ছে। 
জানি তুমি আজ পৃথক পৃথিবীর একজন শান্তসিষ্ট বাসিন্ধা।
যত দুরেই তুমি থাকো না কেন,বাবা মায়ে রা তো সন্তানের মাঝেই বেঁচে থাকে অনন্তকাল ধরে।তুমিও বেঁচে আছ আমাদের মাঝে। আমাদের অন্তর আত্মায়।  যত দুরেই তুমি থাকো না কেন মনে হয় যেন ঔ দুর আকাশে প্রদীপ্ত একটি সন্ধ্যা তারার মত   তোমাকে আমি দেখছি। আমার অন্তর আত্মায় এসে পড়ছে তোমার নিহন আলোর বিকিরন, ঐ দেখা যায়,  সত্যিই তুমি ঝল ঝল করে জ্বলছো।

 ঐ দুরের  আকাশগঙ্গা কিংবা নিহারীকা কুঞ্জের কোন এক গ্রহ-গৃহের 
দর্জার সামনে রাতুল ভরা গ্লাস হাতে আরাম কেদারায় বসে  জোসনা রাতে
  উচ্চ শব্দে বার বার যেন তুমি কাউকে বকছো,যেমনি এই পৃথিবীতে থাকতে
প্রতি সন্ধ্যায় উঠোনে বসে বসে  পাইপ টানতে টানতে  বকতে- ঠিক তেমনি
বাবা তুমি বকছ ,এমনি করে--
জগতে  মিথ্যাবাদীরা সব কুত্তার বাচ্ছা,
উপকারের নামে ছোবাড় (চড়)
জীবনে কারো উপকার করতে নেই---
কুত্তার বাচ্ছারা সব দড়িবাজ, নিমক হারাম, শুয়োরের বাচ্ছারা সব কিছু ভূলে গেছে।
 এই মসজিদের পাশেই আমার বাবা-মা দুজনই চির নিদ্রায় শায়িত, এই মসজিদের জায়গাও আমার বাবা দান
করে গেছেন, আপনারা আমার বাবা মায়ের জন্য দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন তাদেরকে জান্নাত দান করেন, আমিন,



বাবা তোমার মুখে গালি গুলি শুনে শুনে আমরা সবাই  ঘুমিয়ে পড়তাম, আর নির্ঘুমে পোহাত 
প্রায় তোমার প্রতিটা দীর্ঘ দীর্ঘ রজনি।ভালো করে বুঝতাম না তুমি কাকে এমন কর্কশ ভাষায় গালি দিতে।
আমরা না বুঝলেও মা যেন সবি বুঝতেন।

বড় হবার সাথে সাথে আমরাও বুঝতে থাকি।  বাবা তুমি কাদেরকে এমন অশ্রাব্য  ভাষায় গালি দিতে?
তোমার অতি আপনজন, যাদের সাথে তোমার রক্তের সম্পর্ক,  আশে পাশের
 সেই  নিমক হারামদের তুমি গালি দিতে।ওরা নেড়ি কুত্তার মত নেতিয়ে বেহায়ার মত তোমার গালি শুনতো।কারুর মুখে কোনদিন রা শব্দ সরেনি।

কেন গালি দিতে? বড় হবার সাথে সাথে সে গল্প তুমি আমাকে শুনায়েছ অনেক বার।কোর্টের বারান্ধায় খেতের আলে বসে বসে অথবা হাঁটে বাজারে যেতে যেতে।কারণ আমিই তো ছিলাম তোমার একমাত্র হাতের লাঠি।যে সন্তান বাবার কোলে পিঠে বড় হয়ে বাবার হাতের লাঠি হতে পারে,তার চেয়ে সৌভাগ্যবান সন্তান জগতে আর কে হতে পারে।এ কথা ভাবতেই অসম্ভব ভালো লাগায় মন ভরে উঠে । বাবা নিশ্চয় আমি খুবি ভাগ্যবান।আমিই  তোমার সেই হাতের লাঠি সৌভাগ্যবান সন্তান।
বাবা আমি তোমার রক্তের সন্তান, আমি তোমার আদর্শের সন্তান।প্রতিদিন প্রতিক্ষন তোমাকে ধারণ করি,লালন করি অন্তর আত্মায়।জীবন চলার পথে প্রান্তরে, দুঁদে এই অলিতে গলিতে, আমার কালো কালো আকাশে, তুমি প্রতি প্রভাতে উঠো সোনালি  সূর্য্যএর মত, রাতে উঠো পুর্নিমার শশীর মত।তোমার আলোতে উদভাসিত হয়ে হাঁটছি এ জটিল পৃথিবীর আঁকা বাঁকা পথে, ছায়া পথ ধরে উহ্য কুকুরের মত।

বাবা তোমার মুখে শুনেছি তোমার জীবনের গল্প্টা--


সাত ভাইয়ের মধ্যে তুমি ছিলে তৃতীয়, আর আমিও হলাম চার ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয়, দেখ তোমার আমার মাঝে কি অসম্ভব মিল। মানে আমিও তোমার মত সংসারে সেঝ।তোমার একটি বোনও ছিল, আমাদের অদেখা পুফু।ছোট দু ভাইকে উলঙ্গ  রেখে তোমার পিতা না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তোমার বাবা মানে আমাদের দাদার নাকি কলিজার বিমার(ব্যদনা) ছিল।  ছোট একটি সনের ঘর( কুড়ে ঘর) তার ভিতরে তোমরা আট ভাই বোনকে নিয়ে তোমার বৈধব্যা মা, আমাদের প্রিয় দাদি, মাকড়সার মত এতগুলো সন্তানকে আঁকড়ে ধরে বড়ই হিমশিম খেত।ঝাউ আর ভাতের মাড় নিয়ে মারামারি  নিত্য দিনের ব্যপার ছিল তোমাদের সংসারে।রক্তাক্ত হত তোমাদের কুড়ে ঘর হাঁড়ি বাসনপাতি।আজ এর গাল ছুলত তো কাল ওর।টগবার বাড়িতে মাথা পাঠতো।নুন্যতম  বেঁচে থাকার এই নির্মম লড়াই সংগ্রাম তোমার সহ্য হতো না বিধায় একদিন গোপনে মাত্র বার বছর বয়সে তুমি হয়ে গেলে বিভাগী।তোমার কিশোর জীবনের সুন্দর সাম্পান ভাসিয়ে দিলে অন্তহীন মহা সমূদ্রে।

তোমার সেই সুসৌভিত সাম্পান তোমার স্বপ্নের বহু বহু পৃথিবী গুরে অবশেষে প্রাচ্যের পম্পে নগরিতে গিয়ে নোঙ্গার ফেললো।(সন্দীপ হাতিয়া সহ নোয়াখালীর উপকুল অঞ্চল নিয়ে সমূদ্র গর্ভে বিলীন হওয়া নোয়াখালীর আদি শহরকে বলা হয়েছে পম্পে নগর)নতুন দেশ নতুন শহর, নানা বর্ণের মানুষ জনে,নানা রঙের জাহাজ, তার উপর সাগরের উত্থাল ঢেউ এর সাথে আছড়িয়ে পড়ছে প্রাণের স্পন্দন।ভীষন খুদার্থ ছিলে তুমি।পকেটে তোমার একটি পয়সাও ছিল না।পকেট থাকবে কোত্থেকে? গায়ে তো জামাই ছিলনা। চেঁড়া একটি লুঙ্গি পরনে, গায়ে একটি চিন্ন চাদর পাঁ-জোড়া খালি।পেটে অকুতভয় ক্ষিদা, খুদার্থ কাকের মত গুরছো এদিক ওদিক।
অনেক খোঁজার পর অবশেষে কোন এক সুহৃদ খান সাহেবের কাপড়ের দোকানে মিললো তোমার একটা চাকুরি।তাও আবার পেটে ভাতে। বেতন ছিলনা।শুধুই বেঁচে থাকার লড়াই। অজানা অচেনা নগরে সেটাও বড় প্রাপ্য।চার পাঁচ বছর সেখানে থাকার পর পম্পে নগরি সাগর গর্ভে বিলীন হবার পুর্বেই তোমার জীবন সাম্পান নোঙ্গর তুলে আবার ভাসতে ভাসতে গিয়ে ভিড়লো কলিকাতার বন্দরে।সেখানে একটি দোকানে দুবছর চাকুরি করে দশটাকা জমিয়ে তুমি জাহাজের নলি বানিয়ে চাকুরী নিয়ে বিদেশী জাহাজে উঠে পাড়ি জমালে  সমূদ্রের পথে দিগ্বিজয়ি কলম্বাসের মত।পৃথিবীর পথে পথে বন্দরে বন্দরে, তোমার স্বপ্নের নোঙর ফেলে, উত্তর মেরু দক্ষিন মেরু প্রদক্ষিন করে অবশেষে বহুদিন পর ঘরে ফিরেছ।ধুমধামে  ঘরে তুলেছ আমাদের প্রিয়তমা মাকে।

বলা বাহুল্য তোমাদের বিশাল বংশে আমার মা-ই ছিল আরবি বাংলা জানা একজন শিক্ষিত মানুষ।মা যখন তোমাদের পরিবারে এসেছিল তখনও তোমাদের সনের একটি মাত্র ঘর ছিল।তখনও তোমাদের দারিদ্রতা দুর হয়নি।অভাব অনটন লেগেই ছিল।মায়ের মুখে শুনেছি তোমার ছোট দু ভাইকে মা এসে ন্যাংটা গোছল করাতো।মায়ের কাছেই তাদের লেখাপড়ার হাতে খড়ি হয়েছে।তাও আবার একজনের অন্যজন  তো মাস্তান হলো।  তখনও রক্তাক্ত হতো তোমাদের কুড়ে ঘর।ডাস্টবিনের উচ্ছিস্ট নিয়ে কুকুরেরা যেমনি করে।

মাকে রেখে কিছুদিন পরে তুমি তোমার তিন ভাইকে কলিকাতা নিয়ে জাহাজে চাকুরি দিয়েছ।বড় দুভাই কয়বছর চাকুরি করে আর  যায় নাই মাথা গুরার ওঝুহাত তুলে।ছোট এক ভাইকে নিয়ে দীর্ঘদিন ভেসেছো গভির অগভির সাগরের  অথৈ জলে।অনেক টাকা কামায়েছ দু ভাই মিলে, অনেক সম্পত্তি জোড়ায়েছ। কিন্তু সব  ভাইকে সমান ভাগ করে বেঁটে দিয়েছে। কিছুদিন পরে তোমার সেই ছোট ভাইটি আর যায়নি জাহাজে। তুমি একাই ভাসায়েছ তোমার স্বপ্নের সাম্পান।সেই ব্রিটিশ পিরিয়ড থোকে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ পিরিয়ডেও তুমি একাই ভেসেছ।

অনেক টাকা কামায়েছ অনেক সম্পত্তি জোড়ায়েছ।আশে পাশের মানুষেরা মনে করতো জাহাজে চাকুরি করে নয় তোমার কাছে গুপ্ত টাকা বানানোর মেশিন আছে।ঘরে বাহিরে উপছে পড়তো তোমার টাকা পয়সা। বাবা তুমি যত সম্পত্তি জোড়ায়েছ, আজ আমরা চার ভাই ইউরোপ আমেরিকা থেকেও এত সম্পত্তি জোড়াতে পারিনি।এক জীবন প্রায় শেষ ।আমরা চার ভাই তোমার খরিদা সম্পত্তিতেই বাড়ি করেছি।

 বাবা তুমি তো দেশ দেশান্তরে ছুটে বেড়াতে, দরিয়া দরিয়ায় ভাসতে। এদিকে মা একা বাড়িতে ছোট ছোচ সন্তানদেরকে আগলে ধরে বাড়ি থাকতেন। মায়ের মুখে শুনেছি তিন বার আমাদের ঘর ডাকাতি হয়েছিল। মুখোশ পড়ে তোমার ভাইয়েরাই  নাকি ডাকাতি করেছে। মায়ের চিতকারে অন্য বাড়ি থেকে লোক এসে ডাকাত দৌড়ায়েছে, কিন্তু তোমার হিংসুটে ভাইয়েরা কেউ আসেনি। মা বলেছেন নগদ টাকা পয়সা সহ সেরে সেরে সোনারুপা ডাকাতেরা নিয়ে গেছে।

বাবা তোমার ছোট যে ভাইকে তুমি লেখা পড়া শিখায়ে মোক্তার বানাতে চেয়েছ, সেই ভাইটিই আমাদেরকে বেশি হিংসা করেছে।মোক্তার তো হতে পারেনি তিনবার মেট্রিক দিয়ে ফেল হরে কৃষ্ণ স্যারের মুখে শুনেছি। মোক্তার তো হয়নি সে হলো বর্ডার গার্ড।ভূয়া মুক্তি যোদ্ধা। বাবা সাতাত্তর সালের দিকের কথা একাবার মিন্টু আমাদের চরের দুদাগ জমিন  চাষ করেছিল। ধান যখন পেকেছিল তখন তোমার সেই হিংসুটে ভাই মুক্তি ফোজের অস্ত্র তাক করে আমাদের দুদাগ জমিনের ধান কবিরা হাওলাদের সাথে মিলে লুটায়ে দিয়েছে।সে সময় তুমি না কষ্ট পেয়েছ। আর আজ সে ভাইয়ের সন্তানরাই ্ একি কায়দায় তোমার বাবার সম্পত্তি ও তোমার কেনা সম্পত্তি জোর করে দখল করে রেখেছে।তারা এখনও দেখ কেমন ভাবে খুনের নেশায়  মেতে উঠেছে।

  বাবা তুমি আমার বাড়িটা দেখে গেছ। আমি যে তোমাকে বলেছিলাম তোমার চার ছেলেরা  একদিন বড় বড় বাড়ি করবে। দেখ আজ তোমার সনানেরা তোমার জায়াগায় উঁচু উঁচু বাড়ি করেছে। তোমার মসজিদের জন্য দান করা জায়গায় আজ বিশাল মসজিদ হয়েছে।  আর তুমি চলে গেছ ও পারে খালি হাতে সাড়ে তিন হাত জায়গা লয়ে, শুয়ে আছ মসজিদেরই পাশে। ভালো থেকো বাবা সে পাড়ে।



                                                         .....ফারুক, জার্মান প্রবাসি,


অজ্ঞসব জনপ্রতিনীধি,

সত্যই শক্তি, সত্যই সুন্দর,