বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হোসেন মুহাম্মদ এরশাদ একটি ফ্যক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা জাতির জন্য লজ্জাও কলঙ্কের বিষয়। দীর্ঘ নয় বছর কতো আন্দলন সংগ্রামের মাধ্যমে ভার্সিটি এলকায় পানি বিক্রেতা ১২-১৩ বছরের কিশোর বাদশা থেকে নুর হোসেন ডাক্তার মিলনসহ অসংখ্যা প্রাণের বিনিময়ে ৯০ এর ৬ই ডিসেম্বর ঐতিহাসিক গনউভ্যত্থানের মাধ্যমে এই দুষ্ট স্বৈরচারের পতন ঘটে।পৃথিবীর সকল স্বৈরচারদের নির্মম মৃর্ত্যু হলেও এই স্বৈরচার ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। এটা আমাদেরই চরম ভূল।কথায় আছেনা সাঁপ মেরে লেজঁ জিন্দা রাখতে নেই।
১৯৮২ সালের মার্চ মাসের তেইশ বা চব্বিশ তারিখের দিকে তখন বাংলাদেশে চলছিল মেট্রিক পরিক্ষা । আমি তখন ছয়ানি বাজারে চা দোকানে বন্ধুদের সাথে চা-খাচ্ছিলাম। সম্ভবত বাংলা প্রথম পত্রের পরিক্ষা চলছিল ।টেপে জারি গান বাজছিল।হঠাৎ দেখি কেশ টেবিলে বসা লোকটি গান বন্ধ করে খবর ধরলেন। কিচুক্ষনের মধ্যে দেখি দোকানের সামনে অসংখ্য মানুষ এসে জড়ো হয়ে দাঁড়ায়ে খবর শুনতে লাগলো।তাজা এবং গরম খবর।জেনারেল এরশাদ জেনারেল জিয়ার মত রাষ্ট্রপতি আবদুর ছাত্তারকে বন্দুকের নল দেখায়ে ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। অনির্দিষ্ট কালের জন্য সামরিক আইন মার্শাল-ল জারি করা হলো। আমি লক্ষ করলাম সাথে সাথে গ্রামীন মানুষের চোখেমুখে আতঙ্কের চাপ ফুটে উঠলো।আমরা কিন্তু মাইজদীর পোলা হিসেবে একেবারে নর্মাল ছিলাম।কি আর হবে স্বৈরচার আইয়ুবের শাসনামল না দেখেলেও স্বৈরচার জিয়ার শাসনামল তো দেখেছি।
সবাইকে শান্তনা দিয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললাম,কি আর হবে, কয়দিন আর্মিকে দিয়ে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করাবে, তারপর হ্যাঁ না ভোট দিবে, খালি মাঠে গোল দিয়ে নিজে নিজেকে বিজয়ি ঘোষনা করবে,নিজেই দেশের প্রেসিডেন্ট হবে।রাজ কোষের কুঠি কুঠী টাকা খরচ করে দল গঠন করবে।জগতের সকল সৈরচারিরা তো এমনই করে।জোর করে ক্ষমতায় যেতে পারলেই নেসালিস্ট পার্টি ঘঠন করা তাদের চরিত্রের লক্ষন।গনতন্ত্র না হয় কিছু দিনের জন্য আর্মির বুটের তলায় আর তাদের জলপাই রঙের কনভয়ের চাকার নীচে পিস্ট হবে, আর চেয়ে বেশি আর কি হবে?
পরিক্ষা চলাকালিন সময় আমি বেশ কয়দিন সেখানে ছিলাম।ছয়ানিতে আমার এক বোনের বাড়ি থাকার কারনে সেখানের অনেক গনমান্য লোকের সাথে আমার পরিচয় ছিল।ইতিমধ্যে আমাদের শহরে আর্মিরা এসে ঘাঁটি গেঁড়ে বসলো।একেবারে ঠিক পাঞ্জাবীদের মত।একাত্তরের প্রথম দিকে ঠিক পাঞ্জাবীরাও এভাবে এসে আতঙ্ক সৃস্টি করলো আমাদের মাইজদী শহরে।আর্মিরা এসে শহরের দোকান দারদেরকে মারধর শুরু করে দিল,কারো কারো জরিমানা ও করেছে । কেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নাই্? কেন ডাস্টবিন নাই? এই সব কারণে মারছে,জবর দস্তি সবাইকে দিয়ে রাস্তা ঘাট পরিষ্কার করাতে লাগলো। খালে বিলের কচুরিপানা জঙ্গলা জাঙ্গলি চাপ করায়ে পিজের ড্রামে রঙ রাগিয়ে ডাস্টবিন বানিয়ে কোনায় কোনায় বসায়ে দিয়ে একেবারে চাপচুত্র পরিপাটি করে ফেললো।
।প্রতিদিন মা্ইজদী থেকে খবর পাই।আমার মা বাবা এবং বড় ভাই সবাই আমাকে নিয়ে তটব্যস্ত, চিন্তায় অস্তির। আমার মাথার চুলগুলি ছিল একটু লম্বা টাইপের। আর্মিরা লম্বা চুলওলাদের দেখলে নাকি বিষম মারে, এমন কি জেলে ও দেয়।প্রতিদিন আমার ভাই এসে এমন তাজা তাজা গুলি চোড়ে আমার দিকে।শাড়ি পরা মেয়েদের যদি মাথায় গোমটা না থাকে তাহলে নাকি মাথার চুল কেটে দেয়। নাভী উদাম থাকলে নাকি আলকাতরা লাগিয়ে দেয়।আমাদের মাইজদী শহর নাকি এখন অন্য রকম হয়ে গেছে।আরো কতো বাজে খবর শুনাতো আমার ভাই। গ্রামের কেউ কেউ শুনে বলতো মিলিটিরিরা উচিত কামডাই করিতেছে।
আমাকে জনম দেওয়া মাইজদী দেখার জন্য আমি অস্হির হয়ে উঠলাম।রিতিমত কৌতুহলিও। আমি জানি আমার ভীরু বড় ভাইটার স্বশুর বাড়িটাও এই এলাকায় থাকার ধরুন ও ডরে ভয়ে প্রতিদিন নিজের বাড়ি ঘর চেড়ে গ্রামে চলে আসে।আর এসে আমাকে সাবধান করে, তুই এই লম্বা চুল নিয়ে বাড়ি যাইস না, আর্মিরা দেখলে খবর আছে।
ভাইয়ের কথায় আমি রিতিমত বিরক্তিবোধ করতাম। যে আমি কবি নির্মলেন্দু গুনের মত হুলিয়া মাতায় রেখে শহরের থানা পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আমার মায়ের আঁচলের তলে গিয়ে আবদ্ধ হতাম। সে আমি একদিন অনেক অনিকের চোখকেও ফাঁকি দিয়ে বাড়ি চলে গেলাম।মা তো আমাকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে বললো বাবা তুই তাড়াতাড়ি চুল কাটিয়ে আয়।মায়ের অনুরোধে আমি তখন সেলুনে গিয়ে চুল কাটিয়ে এলাম, মা দেখে বললো, না ছোট হয় নাই আবার যা লক্ষিটি চুল কাটিয়ে আয়।আমি মায়ের কথা মত আবার গিয়ে চুল কাটিয়ে এলাম। পরের দিন গেলাম শহর দেখেতে।বাহ! সত্যিই শহরটা ঝকমক করছে একেবারে চাপচুত্রা।প্রতিটি দোকানের সামনে কালো পিজের ড্রাম কেটে রাঙিয়ে আমাকে ব্যবহার করুন ডাস্টবীন সোভা পাচ্ছে।বড়সড় গাছ গুলোর গোড়ায় চুনের শাড়ি পরানো হয়েছে।কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে বড় দিঘীর পাড়ে মাঠের মধ্যে সামরিক আদালত বসানো হয়েছে।বিচারপতি হলেন বিগ্রেডিয়ার রাব্বানি সাহেব।
পুরো শহর গুরে ফিরে গেলাম আর্মির বিচার দেখতে।যেয়ে দেখি আমার বাবার বয়সি এক বৃদ্ধ লোককে আর্মিরা ছাতি ব্যগ কাপড় চোপড় সহ বড় দিঘীতে নামায়ে সাঁতার কাটাইতেছে।তার অপরাধ চর থেকে আসা লোকটি নগরের নিয়ম কানুন না জেনে আর্মিদের বানানো পেন্ডেলের ভিতর বিনা অনুমতিতে ডুকে পড়েছে।তাই এমন জগন্য সাজা দেওয়া হলো।বৃদ্ধ লোকটি পানি খেয়ে ডুবে যাবার দশা হলে আর্মিরা উঠে আসতে বলে।সেদিন অসংখ্য উৎসুখ জনতার সাথে দাঁড়িয়ে আমি এরশাদের সামরিক আইনের একটি নোংড়া বিচার দেখলাম।
ঠিক এরকম জেনারেল জিয়ার আর্মিরা ও সাধারন মানুষের উপর জগন্য অত্যাচার করেছে।আমি নিজেও একদিন তাদের অত্যাচারের শিকার হয়েছি।একদিন মাইজদী কোর্ট স্টেষনে জিয়ার আর্মিরা অনাহুত এমন জোরে আমার দুগালে দুটা থাপ্পর দিয়েছে যে আমি গুরে পড়ে বেহুঁষ হয়ে গেছি। বেশ কয় ঘন্টা পরে আমার হুঁস আসে।আমার অপরাধ ছিল আমি তাদের সামনে ধুমপান করেছি।
যাক জিয়ার কথা, আসি এরশাদের কথা। একটা স্বাধিন দেশে সামরিক আইন জারি করে দিয়ে এই কুখ্যাত এরশাদ স্বাধিন জনতার উপর অনেক অত্যাচার করেছে।বাংলার সহজ সরল নিরিহ মানুষেরা অল্প কয়দিনের মধ্যেই যেন ভুলে গেছে তার অত্যাচারের কথা।যখন দিকে দিকে শ্লোগান উঠছে আর্মি বেরাকে ফিরে যাও, তখন এই চতুর এরশাদ সামরিক আইন লগু করে যুব সংহতি নামে প্রথম একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে।যাক আমার একটা ধারনা ঠিক হলো।
তারপর একদিন একটা খবরের কাগজে একটা খবর শুনে আমি রিতিমত অবাক বিশ্মিত হলাম, যে এরশাদ নাকি আটাইশ বছর পরে সন্তানের বাপ হলো।এই আটাশ বছর এরশাদ আটকুড়া ছিল।আগের প্রেসিডেন্ট সাত্তারও নাকি আজীবন আটকুড়া ছিল।খবরটা কিছুতেই আমার বিশ্বাস হলো না সেদিন।কি করে সম্ভোব?
এই এরশাদ জনগনের মৌলিক ক্ষমতা দখল করে তার আর্মি পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে প্রথমে ভার্সিটি এলাকায় মধ্য ফেব্রুয়ারিতে পানি বিক্রেতা বার তের বছরের বাদশা নামে একটা কিশোরকে গুলি করে হত্যা করে।এই কেশোরকে নিয়ে তখন বাংলাদেশ লেখক শিবির এর পক্ষে কথাশিল্পি আহম্মেদ ছপার নির্দেশে সুনাট্যকার মামুনুর রশিদ একটা নাটক লিখে 'ক্ষুধিরামের দেশে” নামে নাটকটির ছাত্রনেতার চরিত্রে আমি অভিনয় করেছিলাম।কি যে মর্মান্তিক বাস্তব ঘঠনা নিয়ে নাটকটি লেখা ছিল, যারা নাটকটি দেখেছেন বা পড়েছেন অবশ্যই তারা অবগত আছেন।
তারপর ডাঃ মিলন থেকে নুর হোসেন পর্যন্ত এই সৈরচার এরশাদ অসংখ্য তাজা প্রান জরিয়ে দিয়ে কতো মায়ের বুক খালি করেছে, কে তার হিসেব দিবে।সবাই তাকে বলে সৈরচার আর বিশ্ব বেহায়া, কিন্তু কেহ তাকে খুনি বলে না।এরশাদ একজন প্রকৃত খুনি।তার নামে অসংখ্য কেইছ হয়েছে বোধহয় খুনের মামলা হয়নি।
অনেক অপরাধে অপরাধি এরশাদ। এখানে তার কয়েকটি অপরাধের কথা আমি তুলে ধরছি যেমনঃ-
১, এরশাদ গনভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে জবরদস্তি বন্দুকের নল দেখায়ে হঠিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে, এখানে সে রাস্টোদ্রহি অপরাধ করেছে।
২, সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হত্যার সাথে এরশাদ জড়িত।
৩, রাজ কোষের কুঠি কুঠি টাকা খরছ করে রাজনৈতিক দল গঠন করেছে।এটা তার একটা চরম অপরাধ।
৪, সে একজন খুনি, তার নির্দেশে অনেক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।খুনির বিচার হওয়া উচিৎ।
৫, রাস্টের কুঠি কুঠি টাকা খরচ করে সে মাঝারে মাঝারে গিয়েছে, এবং কুঠি কুঠি টাকা মাঝারে দান করেছে।শুধু আজমীর সরিফে ১৯৮৬ সালের জুলাই মাসের দিকে সে দান করেছে বিশ কুঠি টাকা।
৬,কুঠি কুঠি টাকা বিদেশে পাচার করেছে, মিডেলইস্টে তার নিজশ্ব ব্যবসা প্রতিস্টান আছে।
৭, ক্ষমতায় থেকে নিজের স্ত্রি ঘরে থাকতে নারিবাজি করেছে,এবং নামে বেনামে অনেক সম্পদ গড়েছে।
৮,এই এরশাদ তিরিশ লক্ষ সহীদ আর লক্ষ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মহান স্বাধিনতার সাথে মশকরা করে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মরহুম জিয়াউল হকের কাছ থেকে `` খোদ পাকিস্তানি”খেতাব গ্রহন করেছে।
এগুলি ছিল তার চরম অপরাধ।
এই স্বৈরচারি এরশাদ আর্মি অডিনেন্স গঠন করে অবৈধভাবে জবরদস্তি নয় বছর ক্ষমতায় থেকেছে।
১৯৯০ সালের দিকে জনগনের তুমল আন্দলনে ক্ষমতা চাড়তে বাদ্য হয়ে পাঁচ বছর কারাবরন করতে হয়েছে।যে এরশাদ কারাগারে বন্দি থেকে নিঃসর্ত আওয়ামি লীগকে সমর্তন দিয়ে যাবৎজীবন সাজা কিংবা ফাঁসির দড়ি থেকে মুক্ত বা প্রাণে বাঁচলো।সে এরশাদ কেমন করে এখন রাজনৈতিক পেক্টর হয়ে যায়।তাকে নিয়ে কেনই বা এত টানাটানি হবে।কি আছে তার কাছে।অদুর ভবিষ্যতে তার জাতিয় পার্টির কোন অস্তিত্বই টিকে থাকবে না।আমাদের মত আগামি প্রজন্মও তাকে একদিন প্রত্যাক্ষান করবে।সেদিন বেশি দুরে নয়।
আমার কাছে মনে হয় এরশাদ গ্রাম বাংলার একটা ভাঙা সেতু।
আবার আমার কাছে মনে হয়, এরশাদ মরুভূমির একটা চর্মসার উট,
আবার আমার কাছে মনে হয় এরশাদ শিশুর খেলনা কাঠের টাট্টু ঘোড়া,
সব অপকর্মের হেতু।
আমার কাছে মনে হয় এরশাদ পত্র পল্লবহীন একটা বটগাছ।
আবার আমার কাছে মনে হয় এরশাদ জবুথবু বৃষ্টি ভেজা একটা
খেক শিয়াল,গৃহস্তের মোরগ নয়, চায় একদুটা সুটকি মাছ।
আমার কাছে মনে হয় এরশাদ দুর্গত মহামারি অভিসাপ।
আবার আমার কাছে মনে হয় এরশাদ খরা বন্যা, ঘুর্নিঝড়।
আবার মনে হয এরশাদ একটা মরা নদী,তাকে কখনও করা
যায়না মাপ।
-----ফারুক, জার্মানি।